চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হযরত শাহজী পীর ছাহেব (রহ.)

খোন্দকার মোজাম্মেল হক

২ মার্চ, ২০২০ | ২:৫৯ পূর্বাহ্ণ

১৯১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি, বঙ্গাব্দের হিসাবে মাঘ মাসের ১২ তারিখ ১৩১৪ বঙ্গাব্দ, দিনটা সপ্তাহের ঈদের দিন জুম্মাবার পবিত্র শুক্রবার। পবিত্র ধরাধামে এলেন মহান আল্লাহপাকের অফুরন্ত অনুগ্রহে এক আধ্যাত্মিক সাধক ও জামানার সের মহামানব। তিনি আওলাদে রাসুল, আওলাদে হযরত আলী (রা.), আওলাদে ইমাম হুসাইন, আওলাদে হযরত বড় পীর আবদুল কাদির জিলানী (রা.)। চট্টগ্রাম মহানগরীর বাকলিয়ায় এক উঁচু দরের কামেল বুজুর্গ আলহাজ্ব সৈয়দ আবদুর রহিম শাহ (রহ.) এর ঘর আলোকিত করে দুনিয়ায় আগমন করেন যুগশ্রেষ্ঠ মুজাদ্দেদ হযরত সৈয়দ আবদুল বারী শাহ (রহ.)। তাঁর আম্মাজানও হযরত (দ.)-এর বংশধর। তাঁর নাম সৈয়েদা মোসাম্মাৎ মাহমুদা খাতুন। হযরত সৈয়দ আবদুল বারী শাহ (রহ.) ভক্ত মুরীদান-আশেকানদের কাছে শাহজী পীর ছাহেব কেবলা নামেই খ্যাত ছিলেন। চট্টগ্রামের মিরেরশরাইর ছুফিয়া নুরীয়া মাদ্রাসা, বড় তাকিয়ার সন্নিকটে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও চিনকী আস্তানায় ইসলামী শিক্ষালয়ে তাঁর শৈশব ও বাল্যকালের একটি অংশ কাটে। এ সময়ে তিনি পবিত্র কুরআনে হাফেজ হন। অতঃপর তিনি পটিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। চট্টগ্রামের দারুল উলুম মাদ্রাসায় আরবী শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ভারতের সাহরানপুর দারুল উলুমে আরবী, উর্দু ও ফার্সি ভাষার উপর শিক্ষালাভ করেন। এই সময় তিনি ইংরেজি ভাষাও শিখেন। এলমে তাসাউফের প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে লক্ষেèৗর সুফী সৈয়দ দায়েম (রহ.) তাঁকে নিজের খেদমতে নিয়ে যান। উলুম আযম নামে খ্যাতিমান সুফী সৈয়দ দায়েম লক্ষেèৗবী (রহ.) পরবর্তীতে ৪৭-এর পর লাহোরে আস্থানা স্থাপন করেন। সেখানেই তাঁর মাজার শরীফ অবস্থিত। সূফী সৈয়দ দায়েম (রহ.) ছিলেন বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (রা.)-এর আওলাদ। কাদেরীয়া আলিয়া ত্বরীকায় তিনি শাহজী পীর ছাহেব (রহ.)-কে খেলাফত প্রদান করেন। এই পীর-মুর্শিদের সাথে পায়ে হেঁটে ১৯৪৬ সালে বৃটিশ রাজত্বের সময় শাহজী পীর ছাহেব প্রথমবারের মতো পবিত্র হজ্বব্র্রত পালন ও রাসুল পাক (দ.)-এর রওজা মুবারক জিয়ারত করেন।
হযরত শাহজী পীর ছাহেব (রহ.) ছিলেন সম্পূর্ণ প্রচারবিমুখ। তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও তথা আকাশবাণীতে হিন্দি ও উর্দুগানকে বাংলায় অনুবাদ করতেন। নিজেও ইসলামী সঙ্গীত রচনা করতেন। এসব বিষয়ে তিনিই আমাদের অবহিত করেছেন। এরই মধ্যে তিনি বিশ্বের খ্যাতিমান পীর-বুজুর্গদের দরবারে গমন করতে থাকেন। বিভিন্ন সময় অনেক উঁচুমানের বিখ্যাত ওলী-বুজুর্গদের সাথে তাঁর মোলাকাত হয়ে যায়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বিভিন্ন ত্বরীকায় ১৭ জন কামেল মুর্শিদের কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেন। তাঁর মুর্শিদ কেবলাগণ প্রায় সবাই সমকালীন সময়ের গাউস, কুতুব ও মশহুর বুজুর্গ ছিলেন। তিনি বলতেন তামাম দুনিয়ায় একই সময়ে যেই ৪০ জন ইব্রাহিম (আ.)-এর চরিত্রের গাউস থাকেন, তাদের ১৭ জনই তাঁকে অনুগ্রহ করেছেন। উলুল আযম সূফী সৈয়দ দায়েম লক্ষেèাবী (রহ.)-এর কাদেরীয়া আলীয়া ত্বরীকায় সাধনা করেন। এছাড়া তিনি অন্য যেই ত্বরীকায় চর্চা করেছেন তা হলো চিশতিয়া-নিজামীয়া ত্বরীকা।
দিল্লীর উপকণ্ঠে মাহবুবে পাক হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া সৈয়দ বোখারী আল বদায়ুনী (রহ.)-এর আওলাদ, যুগশ্রেষ্ঠ মুজাদ্দেদ হযরত পীরে জামীন শাহ সৈয়দ বোখারী আল্ বদায়ুনী (রহ.)-এর দরবারে তিনি একটা সময় কাটিয়েছেন। তিনি দয়া করে চিশতীয়া-নিজামীয়া ত্বরীকায় শাহজী পীর ছাহেব (রহ.) কে খেলাফত দিয়েছেন। এমনকি চট্টগ্রামের বাহির সিগনালের আল আমীন বারীয়া দরবার শরীফেও তিনি কয়েকবার তশরীফ এনেছেন। শাহজী পীর ছাহেব (রহ.)-এর দুনিয়ার জীবনে এমনি এক বার্ষিক মিলাদুন্নবী মাহফিলে তিনি তাঁর বড় শাহজাদা সৈয়দ বদরুদ্দোজা বারী (মা.জি.আ.)-কে কোলে করে এনে তাঁর নিজের আসনে বসিয়ে দেন। জীবদ্দশাতেই শাহজী পীর ছাহেব এই বড় শাহজাহাদাকে সাজ্জাদানশীন হিসেবে ঘোষণা করেন। দীর্ঘদিন যাবত মাহফিলের চিঠিতেও বড় শাহজাদার নামের পাশে দরবারের সাজ্জাদানশীন লেখা থাকতো।
শাহজী পীর ছাহেব (রহ.) মূলত সেই ব্রিটিশ আমলে ১৯৪০ সালের দিকে আধ্যাত্মিকতায় খুবই উঁচু দরজায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু রেয়াজত, সাধনা ও প্রকাশ সবই ছিল গোপন। তিনি কারো কাছে ধরা দিতেন না। ১৯৬৪ সালের শেষের দিকে হঠাৎ হযরত শাহজী পীর ছাহেব কেবলা নিখোঁজ হয়ে যান। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন কেউ জানতো না তিনি কোথায় আছেন। এ সময় জানা যায় যে, তিনি মজ্জুব হালতে সিলেট শহরতলীর গোলাপগঞ্জ এলাকার এক জঙ্গলে রেয়াজতে আছেন। গভীর জঙ্গল হওয়ায় স্থানটি বন্য জন্তু-জানোয়ারের বিচরণের ক্ষেত্র ছিল। এখানে দিনের বেলাও কেউ সাহস করে যেতো না। এই জনমানবহীন গভীর জঙ্গলে বাঘ, সাপ ইত্যাদির বিচরণের ভেতরে কিভাবে তিনি দীর্ঘ সময়, কারো মতে এক যুগ তথা ১২ বছরের মতো অবস্থান করলেন, কে সেখানে খাদ্য ও পানীয়ের যোগান দিল একটা চির রহস্য হয়ে আছে। একটি পাথরে হাত রেখে তিনি এই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। সেই পাথরে শাহজী বাবাজানের হাতের চাপ এখনও অক্ষত আছে। এই পাথরটি হয়ত শাহ সুন্দর (রহ.)Ñএর মাজার শরীফে সংরক্ষিত আছে। শাহ সুন্দর (রহ.) ছিলেন হযরত সৈয়দ শাহজালাল ইয়েমেনী (রহ.)-এর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম একজন।
আওলাদে রাসুল, পীরে কামেল হযরত শাহজী বারী বাবা (রহ.)-এর কারামতের প্রকাশ শুরু হয় সেই চললিশ দশক থেকেই। তবে ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ দশকে এসব আলোচিত হতে থাকে। চট্টগ্রামের তৎকালীন নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী এ সময় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীও যে কোনো সমস্যা দেখা দিলেই হুজুর কেবলার শরণাপন্ন হতেন। ১৯৬৮ সালে শাহজী বাবাজানের সাথে দেখা করলেন চাঁন্দগাঁও কালুরঘাট এলাকার একজন বিশ্বস্ত আশেক শেখ মাজনুল হক। তাঁর এই এলাকার বড়–য়াপাড়ার ভেতরে কিছু জমি ছিল। তিনি বাবাজান কেবলাকে এখানেই দরবার শরীফ স্থাপনের জন্য জমিটি দান করেন। অথচ এই এলাকাটি বৌদ্ধ ধর্মের লোকজনের এলাকা। এ ছাড়া জমিটি যেখানে তার চার পাশে বৌদ্ধদের মধ্যে যারা যাদু-টোনার চর্চা করে তাদের আস্তানা। তারা কোনোভাবেই চায়নি তাদের এই নরকরাজ্যর মধ্যে মুসলমান সাধক শাহজী বাবার আস্তানা গড়ে ওঠুক। শাহজী পীর ছাহেব (রহ.) এখানেই একটি ছোট মসজিদ এবং কুরআন হেফজখানা প্রতিষ্ঠাতা করেন। হেফজখানা তৈরির সময়ের একটা ঘটনা। তিনি নামাজরত ছিলেন। এ সময়ে দেখা গেল একটা বিশাল আকৃতির বিষধর গোখরা সাপ তাঁর দিকে ফণা বিস্তার করে আছে। অনেকে ভয়ে পিছু হটলো। তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। নামাজের সালাম ফিরিয়ে সাপের দিকে তাকালেন। তাঁর নূরানী চাহনীতেই সাপের ফণা নেমে গেল। তিনি সাপকে বললেন, “হয়েছে হয়েছে, এবার চলে যা”। সবাই দেখলো সেই অবাক কারামত, সাপ বিপরীত দিকে চলে গেল ফণা নামিয়ে।
হযরত শাহজী বাবাজান চান্দগাঁও দরবার এলাকায় কারও উপর কোনো জোর করেননি। কাউকে অনুরোধও করেননি। বড়–য়ারাই এক সময় আল্লাহ পাকের এই ওলীকে তাদের পার্শ্ববর্তী জমিসমূহ স্বেচ্ছায় দিয়েছেন। তিনি বাজারমূল্য অনুযায়ী সবাইকে অর্থ পরিশোধ করেছেন। যদিও তারা কোনো অর্থই নিতে রাজী ছিল না। বহু বড়–য়া জীবনের অন্তিম মুহূর্তে শাহজী বাবাজানের দর্শন চেয়েছে। বিধর্মী এই লোকগুলোর কাছেও তিনি ছিলেন একজন সাক্ষাৎ অবতার। তারাও ছুটে আসতো যে কোনো সময়। তিনি দূর থেকে তাকালেই তাদের সমস্যা ও রোগ-শোক দূর হয়ে যেতো।
রাসূল (দ.)-এর তিনি যে কত বড় প্রেমিক ছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহর রাসুল (দ.)-এর একটা নাথ শুনে পকেট উজাড় করে সব বিলিয়ে দিতেন। বেখোদ হয়ে যেতেন, ঘোরের মধ্যে বেপরোয়া হয়ে পড়তেন। বলতেন, এই নাতশরীফই আমার খোরাক। টাকা-পয়সার জন্য তাঁর কেনো লোভ ছিলো না। বলতেন হাদীয়া দেয়াও সুন্নাত নেয়াও সুন্নাত। তিনি এক হাতে নিতেন, অন্য হাতে দান করে দিতেন। কোন রূহানী সন্তানের কি অভাব আছে, তিনি জানতেন। এমনভাবে তা সমাধান করে দিতেন যে, সেই সন্তান টেরও পেতেন না। কারো কাছ থেকে ধন-সম্পদ ও টাকা পয়সা কখনোই চাননি। উরস, জসনে জৌলুস, মিলাদুন্নবী (দ.) মাহফিলেও কোনো চাঁদা তুলতেন না। তিনি বলতেন, রাসূল (দ.)-এর আওলাদদের কারো কাছে হাত পাতা নিষিদ্ধ। মুরীদ-ভক্তরা যা দিতেন হাদীয়া হিসেবে, তিনি তা গরীব-মিসকীনদের বিলিয়ে দিতেন। মুফতী মাওলানা ওবায়দুল হক নঈমী স্বাধীনতার পর একটা বিশেষ সময় ছিলেন বাবাজান কেবলা (রহ.)-এর খেদমতে। তিনি প্রকাশ্য মাহফিলে বলেছেন, আমি দেখেছি কত লক্ষ-কোটি টাকা হুজুরের কাছে আসতো। রাতে এলো, সকালে নেই। সবই বিলিয়ে দিয়েছেন। এসব জমা রাখলে একটা বাংলাদেশ ব্যাংক হয়ে যেতো। তাঁর দেয়া অর্থে অনেক মানুষ বিপদ থেকে উদ্ধার লাভ করেছে। কত মেয়ের বিয়ে হয়েছে, কত ছেলে-মেয়ে শিক্ষা লাভ করে পন্ডিত হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক প্রধান সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট