চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

১ মার্চ, ২০২০ | ৩:২৫ পূর্বাহ্ণ

কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই আরেক দফা বাড়ানো হলো পানি ও বিদ্যুতের দাম। বৃহস্পতিবার গ্রাহকসহ সবপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে খুচরা প্রতি ইউনিট ৩৬ পয়সা ও পাইকারিতে ৪০ পয়সা। নতুন এই দাম কার্যকর হবে চলতি মার্চ থেকেই। অন্যদিকে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসা। চট্টগ্রাম ওয়াসায় আবাসিকে ৯.৯২ টাকা থেকে ২ টাকা ৪৮ পয়সা বাড়িয়ে ১২.৪০ টাকা এবং শিল্প ও বাণিজ্যিকে ২৭.৫৬ থেকে ২ টাকা ৭৪ পয়সা বাড়িয়ে ৩০.৩০ টাকা করছে। তবে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো ঘোষণা করা হয়নি। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণে পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালনÑ তিন ক্ষেত্রেই ভোক্তাদের প্রতি মাসে বাড়তি টাকা গুনতে হবে। সাধারণ গ্রাহকপর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি দিতে হবে। এছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন মূল্যহার বা হুইলিং চার্জ প্রতি ইউনিটে শূন্য দশমিক ২৭৮৭ টাকা থেকে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে শূন্য দশমিক ২৯৩৪ টাকা। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মূল্য বৃদ্ধির এই ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। পানি ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত জনস্বার্থের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এমনিতেই চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির চাপে স্বল্পআয়ের মানুষজন দিশাহারা। পানি ও বিদ্যুৎবিল বাবদ বাড়তি ব্যয় নাগরিক ভোগান্তির পরিসর আরো বাড়িয়ে দেবে। পানি ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি খাতেই।
এবারসহ গত ১০ বছরে খুচরা বা গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ল সাতবার। আর পাইকারি পর্যায়ে বেড়েছে পাঁচবার। অর্থাৎ মোট তেরো বার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে এক বছরের মধ্যে দু’বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) উচ্চ আদালতে একটি রিট করে। আদালত বছরে দু’বার দাম বাড়ানোর কথা আইনের কোথায় আছে জানতে চাইলে বিইআরসি তখন এর ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। এবার দাম বাড়ানোর আগে মন্ত্রিসভা জ্বালানির দাম বছরে একাধিকবার পরিবর্তন করা যাবে, এমন বিধান রেখে বিইআরসি (সংশোধন) আইনের খসড়া অনুমোদনও দিয়েছে। কিন্তু দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখ্য, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে পরিচালন ও জনবল বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন ও সরঞ্জামের মূল্য বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। তবে জ¦ালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতির মূলোৎপাটন ও অযৌক্তিক ব্যয় কমালে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দরকার হয় না।
লোকসান কমানো, রাজস্ব ঘাটতি ও ঋণের পরিমাণ কমানোর অজুহাতে বাড়ানো হলো পানির দামও। জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসার দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দেওয়ার পর আগামী এক মাস পর থেকে কার্যকরে উদ্যোগ নিতে দুই ওয়াসাকে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। রাজশাহী এবং খুলনা ওয়াসাও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ফলে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্বে থাকা চারটি প্রতিষ্ঠানেরই পানির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বিদ্যুতের বাড়তি বিলের সঙ্গে পানির বর্ধিত দামও নতুন করে যোগ হবে। দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে দুই ওয়াসা বলছে, প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রয় মূল্যের সামঞ্জস্য রাখা এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ বর্তমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করতে পানির দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়াও ওয়াসা উন্নয়নে বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্প শেষ করতে দাম বাড়ানোর যুক্তি দেখানো হয়েছে। উল্লেখ্য, বছরে একবার বাড়ানোর কথা বলা থাকলেও একই বছরে ওয়াসার একাধিকবার পানির দাম বাড়ানোর নজির আছে। পানির দাম বৃদ্ধি পক্ষে নানা যুক্তি দিলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।
মানবসভ্যতার এ সময়ে পানি ও বিদ্যুৎ ছাড়া জীবন অচল, পানি ছাড়া জীবন বাঁচে না, উন্নয়নের চাকা চলে না বিদ্যুৎ ছাড়া। কৃষি, শিল্পোৎপাদন, শিক্ষা, চিকিৎসা, উপাসনাসহ জীবনের সাথে সম্পর্কিত সবক্ষেত্রেই পানি ও বিদ্যুৎ ওৎপ্রোতভাবে যুক্ত। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পানি ও বিদ্যুতের চাহিদানুপাতে উৎপাদন এবং যুক্তিসঙ্গত দামে বিতরণের বিকল্প নেই। কিন্তু লোকসান কমাতে অনিয়ম-দুর্নীতি-লুটপাট বন্ধে কঠোর পদক্ষেপের পরিবর্তে বার বার অযৌক্তিক দাম বৃদ্ধির দিকে হাঁটলে নাগরিক জীবনে এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নানা কারণে এমনিতেই দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব বিরাজমান, পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার পর অর্থনীতি আরও কঠিন চাপে পড়বে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মানে সর্বত্র এর ‘চেইন রিঅ্যাকশন’ হওয়া। কলকারখানা, কৃষিসহ উৎপাদনমুখী সব শিল্পে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। শিল্পের উৎপাদন খরচ থেকে শুরু করে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষ আরো বেকায়দায় পড়বে, যা একটি গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য হতে পারে না। সবদিক পর্যালোচনা করে পানি ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করি আমরা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট