চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মরুময় মক্কা-মদিনায় কয়েকদিন

নাসের রহমান

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৩:১৬ পূর্বাহ্ণ

অন্যকে সুযোগ করে দেওয়ার মধ্যে শুধু মহত্ব প্রকাশ পায় না এতে সওয়াবের ভাগীদারও হওয়া যায়। কাবা ঘরের কাছাকাছি থেকে তাওয়াফ করতে ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি বেশী হয়। অনেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটতে থাকে। মাকামে ইব্রাহীম পার হলে উত্তর-পশ্চিম দিকে হাতিমের অংশ যা অনেকটা অর্ধ প্রাচীর তুলে আলাদা করা হয়েছে। এটাও নাকি এক সময়ে কাবা ঘরের অংশ ছিল। এ জায়গায় নামাজ পড়ার মাঝে আলাদা ফজিলত রয়েছে। এটা কাবার সাথে একেবারে সংলগ্ন।

অনেকটা সংরক্ষিত থাকে। এখানে অনেকে ভীড় করে নামাজ পড়ার জন্য। এ পাশে উপরে দিকে একেবারে চাঁদের কাছাকাছি নকশাখচিত সোনালী রঙের একটা নলের মত যুক্ত আছে। মুখটা অনেকটা বাঁকা হয়ে নীচের দিকে। হয়ত কোন সময় চাঁদে পানি জমলে তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটাও এত সৌকর্যময় তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। সহজে চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু তাওয়াফ শুরু করলে থামার কোন সুযোগ নেই। দোয়া-দরূদ পড়তে পড়তে সবাই সামনের দিকে আগায়। কয়েকজন মিলে দলবেঁধে হাঁটে। এরা এমনভাবে থাকে যেন কোনভাবে একজন থেকে আরেকজন ছুটে না যায়। কেউ হাত ধরে থাকে। পেছন থেকে কাঁধের উপর হাত রেখে হাঁটতে থাকে। এমনও আছে একজনের কাপড়ের সাথে আরেক জনের কাপড় গিট দিয়ে রাখে যেন এক অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। ছোটবড় এরকম নানারকম দলবেঁধে একের পেছনে আরেকজন তাওয়াফ করে। বড় দল হলে শুধু পেছনে নয় আশেপাশে কয়েক লাইন করে হাঁটতে থাকে। দোয়া দরূদ উচ্চৈস্বরে পড়তে থাকে। সামনে একজন বলে যায় পেছনে সবাই তার সাথে সুর মিলিয়ে পড়ে যায়। অবাক লাগে যখন চীন বা মঙ্গোলিয়া থেকে আসা নারী-পুরুষ সমবেত কণ্ঠে দোয়া দরূদ পাঠ করে। তাদের স্বরটা এমন দূর থেকে শুনলে মনে হয় কোনো কোরানের সুর ভেসে আসছে। আবার কেউ কেউ বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ার এরা এত মিহি সুরে দরূদ পড়ে যেন মনটা ক্ষণিকের জন্য বিভোর হয়ে যায়। এরা দল বেঁধে একটু দ্রুত গতিতে পাশ দিয়ে চলে যায়। তাদের পোশাকও আলাদা। রং বেরংয়ের পোশাক পরে পুরুষেরা। মেয়েরা হলুদ কিংবা বেগুনি রঙের চাদর জড়িয়ে তাওয়াফে আসে। এরা বড় বড় দল বেঁধে পুরো মাতামে ঘুরতে থাকে। কাপড়ের রং যা হউক সবার মনের অভিব্যক্তি একই রকম।

অবয়বের দিকে তাকালে সহজে বুঝা যায় কত বেশি মার্জিত। শুধু এরা নয় পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নানা রকম লোকের সমাগম হয়েছে। কেউ কালো, কেউ ফর্সা, কেউবা তামাটে বর্ণের। লম্বা বেটে, মাঝারী চিকন মোটা নানা রকম বিচিত্র ধরনের মানুষ। নাইজেরিয়ানরা এত দীর্ঘদেহী কালো মোটা তার পাশে ফিলিপাইনের কাউকে দেখলে মনে হয় কত বিচিত্র মানুষ এ পৃথিবীতে। আবার নানান বয়সী তরুণ তরুণী থেকে শুরু করে যুবক প্রৌঢ় বৃদ্ধ, বৃদ্ধা। সুন্দর-অসুন্দর এসবের কোনো বালাই এখানে নেই। সবাই যেন একই কাতারে বন্দি, একই পথের যাত্রী। হাজার-লক্ষ নরনারীর মনের অভিব্যক্তি অভিন্ন। প্রার্থনাও এক উচ্চারণও এক। লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক। আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির।
বিভিন্ন দেশের মানুষেরা দলে দলে কিংবা জুটি বেঁধে অনেকে আবার একাকী কখনো দ্রুত কখনো জোড় কদমে হেঁটে যেতে চায়। তবে ইরানীরা দল বেঁধে বা একা একা তাওয়াফ করলেও তাদের সহজে আলাদা করা যায়। বিশেষ করে যাদের মাথায় পাগড়ি, মুখে সাদা দাঁড়ি, পরনে লম্বা জুব্বা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। কখনো কখনো পেছনে পেছনে অনুসরণ করতে মন চায়। কিন্তু তা বেশিক্ষণ সম্ভব হয় না। পাশের কারো সাথে সহজে লাগেনা। ধীর পায়ে একেবারে দোয়া দরূদ পড়তে পড়তে শান্তভাবে এগিয়ে যায়। পাশের জনেরা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলেও এদের গতির কোনো পরিবর্তন নেই। অনেকটা নীচের দিকে তাকিয়ে সামনে চলে। কারো দিকে তাকায় বলেও মনে হয় না।

একমনে একাগ্রচিত্তে কিছুটা হেলেদুলে হাঁটতে থাকে। খুব ভীড় হলেও খানিকটা থেমে থাকে। ভীড় একটু কমলেও আবার ধীর পায়ে চলতে শুরু করে। এরা সম্ভবত আলেম ওলামা। খুব বেশী দেখা যায় না। মাঝে-মধ্যে চোখে পড়ে। দেখলে ভক্তিতে মনটা ভরে ওঠে। পাশে পাশে কিছুক্ষণ হাঁটলে পেছন থেকে একজন ঢুকে যায়। পরপর কয়েকজন এগিয়ে গেলে তাকে আর অনুসরণ করা যায় না। তিনি সবার মাঝে মিশে যান।

আমাদের দেশে অনেক আগে এরকম মৌলানা দেখা যেতো যাদের দেখলে সহজে মানুষ ভক্তি করতো। দেহ সৌষ্ঠব এদের মত এত বড় ছিলনা কিন্তু আচার-আচরণে চলাফেরায় অনেকটা এদের মত মনে হতো। মুখাবয়বে অর্থাৎ চেহারায় একটা নুরানীভাব বিরাজ করতো। এরা শুধু ধর্মীয় জ্ঞান বা কোরানের আলোতে আলোকিত নয়, সার্বিক জ্ঞানেও সমৃদ্ধ। এখন আমাদের দেশের অনেকে দাঁড়িতে মেহেদী লাগিয়ে রাঙিয়ে তুলে কিংবা কালো করে রাখে। এত করে দাঁড়িগুলো আর মুখের উপর শুভ্রতার আলো ছড়ায় না। সাদা দাঁড়িতে সৌন্দর্য আলাদা।
বয়সের সাথে এসব সৌকর্য যেন আলাদা একটা বৈশিষ্ট্যে উপনীত করে। শুধু ইরানে নয় এ ধরনের লোক অনেক দেশে আছে। হয়ত এখানে চোখে পড়েনা। সাতবার ঘোরার হিসাবটি অনেক সময় গোলমেলে মনে হয়। পাঁচ বার ঘুরে মনে হয় চার বার হলো নাকি। এজন্য বেশিরভাগ লোক সাত দানার তজবি ব্যবহার করে। কেউ কেউ আঙুলের কড়ে হিসাব রাখার চেষ্টা করে। দলের লোকের মধ্যে এটাও নিয়ে বিভ্রান্তি হয়। কেউ বলে পাঁচ বার আবার কেউ বলে ছয় বার। কমবেশি হলেও সাতবার না ঘুরে কেউ তাওয়াফ শেষ করে না। গণনার ভুল হলে একবার বেশী ঘুরে। কিন্তু কম কেউ করে না। তবে যারা ধীর-স্থির একাগ্র চিত্তে তাওয়াফ করে তাদের কোনো ভুল হয় না। প্রতিবারই হাজরে আসওয়াদের বরাবর এসে দু’হাত উপরে তুলে চুমু দিয়ে পরবর্তী চক্কর শুরু করে।

নাসের রহমান ব্যাংকার ও কথাসাহিত্যিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট