চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

২৮ ফেব্রুয়ারি ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস

ইনসুলিন যার দরকার, ইনসুলিন তার অধিকার

হাসিনা আকতার লিপি

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ডায়াবেটিস একটি আজীবনের রোগ। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই রোগ আপনার সঙ্গেই থাকবে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশেই ডায়াবেটিস একটি বড় স্বাস্থ্যসমস্যা। বর্তমানে কম-বেশী প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে আধুনিক খাদ্যব্যবস্থা এবং চিকিৎসা গ্রহণ করে, জীবনযাত্রার প্রণালী একটুখানি পরিবর্তন করেই এ রোগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

নানা কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে, তবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বংশপ্রভাব, স্থ’ূলতা, অলস জীবন-যাপন, সংক্রামক রোগ, অপুষ্টি, মানসিক চিন্তা প্রভৃতি। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগ বেশী হতে দেখা যায়। ইদানীং ১-১৮ বছরের শিশুডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই এখনই সচেতন হতে হবে এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে হবে। সারা বাংলাদেশের ডায়াবেটিক হাসপাতালসমূহ এই দিবস পালনের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তোলে। আজকাল অনেকেরই কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কারণ ডায়াবেটিস হচ্ছে নীরব রোগ (ঝরষবহঃ উরংবধংব), তাই বংশে থাকলে, ওবেসিটি থাকলে, এমনকি ওজন কম থাকলেও তাদের সচেতন হয়ে বৎসরে একবার ডায়াবেটিক পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া জরুরী।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা : ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসাপদ্ধতির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অন্যান্য জটিলতার সম্ভাবনা কমানো। ইনসুলিন অনির্ভর ডায়াবেটিস রোগে খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চিকিৎসাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। অন্যদিকে ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস রোগে পথ্য একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যে কোন প্রকারের ডায়াবেটিসে খাদ্য অবশ্যই পুষ্টিসম্পন্ন হওয়া উচিত। খাদ্যের মৌলিক বিভাগের প্রত্যেক বিভাগ থেকে কম-বেশি পরিমাণে খাদ্য নির্বাচন করা যায়। মাঝারী শ্রমে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য প্রতি কেজি ওজনে ৩০ ক্যালরি এবং স্থ’ূল ব্যক্তিদের জন্য প্রতি কেজি ওজনে ২০-২৫ ক্যালরি ধার্য করা হয়ে থাকে। মোট ক্যালরির ৬৫-৭০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য হতে গ্রহণ করতে হবে। জটিল শর্করা যেমন ভূসিসমেত আটা, ঢেঁকি ছাঁটা চাল, ডাল, বাদাম, সীমের বীচি, ছোলা প্রভৃতি খাদ্য নির্বাচন করা উচিত। মোট ক্যালরির ১৫-২০ শতাংশ প্রোটিন জাতীয় খাদ্য থেকে গ্রহণ করতে হবে। কিছু প্রাণীজ এবং কিছু উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের সংমিশ্রণে এই চাহিদা পূরণ করা যায়।

ডায়াবেটিস রোগের খাদ্য ব্যবস্থায় তেল, চর্বির পরিমাণ মোট ক্যালরির ২৫-৩০ শতাংশ ধার্য করা হয়। তবে উদ্ভিজ্জ তেল স্বাস্থ্যসম্মত। সম্পৃক্ত চর্বি-যেমন ঘি, মাখন, ডালডা এবং কোলেষ্টেরল সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন কলিজা, মগজ, ডিমের কুসুম, গলদা চিংড়ি প্রভৃতি বর্জন করা ভাল। সারাদিনের খাদ্য প্রণালীকে তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। পাঁচ ভাগের এক ভাগ সকালের নাস্তায়, ২ ভাগ দুপুরে এবং ২ ভাগ রাতে খেতে হবে। বেলা ১১টা ও বিকাল ৪-৫টার দিকে হাল্কা নাস্তা খেতে হবে। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য পরিমাণমতো পুষ্টিকর খাবার গ্রহণেই রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। মেদবহুল ও মোটা ব্যক্তিদের ধীরে ধীরে ওজন কমিয়ে কাঙ্খিত ওজনে আনতে হবে। আহারে টাটকা ও মৌসুমী ফল জাম্বুরা, আমড়া, পেয়ারা, কামরাঙ্গা এবং সব্জি-শশা, লাউ, ঝিঙ্গা, ঢেঁড়স প্রভৃতি দৈনিক ১৫০-২৫০ গ্রাম পরিমাণ খাওয়া যেতে পারে, কারণ এগুলোতে তেমন ক্যালরি থাকে না। ডায়াবেটিস হলে খাদ্যব্যবস্থা সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। অর্থাৎ কোনটা খাওয়া যাবে কম অথবা বেশী। আর কোনটা সম্পূর্ণ নিষেধ। এই পরিষ্কার ধারণা আপনি আপনার পুষ্টিবিদের কাছ থেকে নিতে হবে। আপনার চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদ আপনার কাজের ধরণ দেখে সারাদিনের জন্য খাবারের পরিমাণ লিখে দিবে। কোন সময় কি ধরণের খাবার খেতে হবে। ডায়াবেটিসের সাথে যদি অন্য কোনো সমস্যাও থেকে থাকে সেই অনুযায়ী খাদ্যের তালিকা ঠিক করে জেনে নিন এবং সেই অনুযায়ী চলুন।
খাবারের ব্যাপারে কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, ১. ডায়াবেটিস হলেই খাওয়া দাওয়া খুব কন্ট্রোল করতে হয়। সারাদিন না খেয়ে থাকতে হবে এমন কথা ঠিক না। ২. ভাল ভাল খাবার, মজার মজার সব খাবার বন্ধ করে দিতে হবে। ৩. মাছ/মাংস কিছুই খাওয়া যাবে না। ৪. গরুর মাংস তো খাওয়াই যাবে না। ৫. মাটির নীচের সব্জী আলু, কচু, মূলা, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমড়া এসব তো ধরাই যাবে না। ৬. মিষ্টি কুমড়া, গাজর ছোয়াও যাবে না। ৭. আতপ চালে তো নাকি সুগার বেশী তাই খাওয়া যাবে না। ৮. মিষ্টি ফল যেমন কলা, আম, আপেল, কমলা, কাঁঠাল নাকি খাওয়া যাবে না। ৯. দুই বেলা নাকি রুটি খেতে হবে। ১০ দুধ, ডিম খাওয়া যাবে না। ইত্যাদি ইত্যাদি নানারকম প্রশ্ন ডায়াবেটিক রোগীরা আমাকে করে থাকে। যতটুকু মনে পড়লো ততটুকু আমি পাঠকের সামনে তুলে ধরলাম। উপরের সবগুলো প্রশ্নই ভ্রান্ত ধারণা থেকে করা তা’ ইতিমধ্যে আমরা খাদ্য নির্বাচনের চিত্র থেকে জেনে গিয়েছি। অতএব সঠিক খাদ্যব্যবস্থা জেনে নিন, সুস্থ, সুন্দর কর্মক্ষম জীবন যাপন করুন। একটা কথা মনে রাখতে হবে- অপ্রয়োজনীয় কথা প্রচার বেশী পায়। যেমন ঃ আলু খাওয়া যাবে না, এটা যেভাবে প্রচার পেয়েছে, ঠিক সেভাবে মিষ্টি খাওয়া নিষেধ ঐভাবে প্রচার পায় নাই। যে কারণে ডায়াবেটিক রোগী সিঙ্গারা খেতে বসলে আলু ফেলে দেয়, কিন্তু বিয়ে বাড়ীতে গিয়ে এক বোতল কোক-ফান্টা ঠিকই খেয়ে ফেলে।

ব্যায়াম : সপ্তাহে অন্ততঃ ৫ দিন ৩০ মিনিট করে হাঁটতে হবে। এই হাঁটাটা যে রাস্তায় হাঁটতে হবে তা কিন্তু বাধ্যতামূলক না। আজকে ঝড়-বৃষ্টি হলো রাস্তায় যেতে পারলেন না। তাই বলে কি হাঁটা হবে না? না হাঁটলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে কেমন করে? অবশ্যই হাঁটতে হবে। কিভাবে? ঘরেই ব্যবস্থা করতে হবে। বারান্দায়, ঘরের লম্বা জায়গায় এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত বারবার হাঁটা, একটু দ্রুত গতিতে, ৩০ মিনিট যথেষ্ট। যারা বয়ষ্ক, প্রবীণ, হাঁটুতে অথবা পিঠে ব্যথা তারা বারান্দার বা জানালার গ্রিল ধরে অথবা টিভি দেখার সময় একটা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে পা দুটোকে উপর-নীচ অর্থাৎ ডান-বাম, বাম-ডান করতে হবে। যতটুকু জোরে আপনার সামর্থ্যে কুলায়। এভাবে ৩০ মিনিট হাঁটলেও হবে। বেশী জায়গার দরকার হলো না, অল্প জায়গাতেই কাজটা হয়ে গেলো। আজকাল তো হাঁটার জায়গার বড়ই অভাব। ঘরেই কাজটা সারুন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
সাধারণ কিছু নিয়ম মানলেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যেমন ঃ ১. ‘হাইপোগ্লাইসেমিয়া’ যাতে না হয় সেজন্য ৩-৪ ঘণ্টা পর পর অবশ্যই কিছু খাবার খেতে হবে।২. ডায়াবেটিস রোগী দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে যদি ৫-৬ ঘণ্টা গাড়িতে থাকতে হয় সাথে খাবার (বিষ্কুট, কলা, পানি, শুকনো খাবার) রাখুন। ৩. বছরে একবার করে চোখ পরীক্ষা করুন। ৪. শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ৫. পায়ের যতœ নিন। ৬. রক্তের চর্বি পরীক্ষা করুন এবং নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ৭. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ৮. ঔষধ বা ইনসুলিন ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিবেন না। যদি ডাক্তার ঔষধ বা ইনসুলিন নিতে বলে তবে তাঁর পরামর্শ ছাড়া বন্ধও করবেন না। যতদিন ডাক্তার নিতে বলবে ঠিক ততদিনই নিতে হবে। ৯. ইনসুলিন ইনজেকশন ঠিক জায়গায় সঠিক নিয়ম জেনে তারপর পুশ করুন। ১০. ‘হাইপো’ লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে মিষ্টি খাবার খেতে হবে।

হাসিনা আকতার লিপি এ্যাসিস্টেন্ট ডাইরেক্টর ও প্রধান পুষ্টিবিদ, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট