চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মোহাম্মদ বেলাল হোসেন

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দেন। সোহরাওয়ার্দী এই অবস্থানে দৃঢ় থাকলে ভাষা আন্দোলন অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারত। এই ধারনা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁর সমর্থন আদায় করেন। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, “সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষা সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা বেশ অসুবিধায় পড়েছি। তাই ঐ বছর জুন মাসে আমি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলা ভাষার দাবির সমর্থনে তাকে একটি বিবৃতি দিতে বলি। ফলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন”। ওই বিবৃতিটি ১৯৫২ সালের ২৯ জুন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে শেখ মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়- আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তো।” ২৭ এপ্রিল ১৯৫২ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করার সময় অসুস্থতাবশত এক পর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সভাপতির লিখিত ভাষণ পাঠ করেন কমরুদ্দীন আহমদ। ওই প্রতিনিধি সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫২ সালের পরও বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে ছেড়ে যাননি। ভাষা আন্দোলনের সফলতার পর্বে তার অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলি বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইন সভায় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সে দিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট প্রণীত ২১ দফার প্রথম দফা ছিল “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন। ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবি জানান। ৭ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, “পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যে সব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে, এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলা ও রাষ্ট্রভাষা হোক। ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে আইন সভার অধিবেশননেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।” পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে ২৩ মার্চ পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রথম সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমৃত্যু বাংলা ভাষার একনিষ্ট সেবক হিসেবে বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের লক্ষে কাজ করে গেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্ভর সংবিধান প্রণীত হয়। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। যে সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা তিনি পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এটাই ছিল প্রথম সফল উদ্যোগ। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলাভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারি নির্দেশ জারি করেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তাঁর ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়”।

বাংলা ভাষা আজ দেশের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর টঘঊঝঈঙ ২১ ফেব্রুয়ারি কে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনা করেছে। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র শুধু দিবসটি পালন করছে তা নয়, বিন¤্র শ্রদ্ধায় স্মরন করছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মাতৃভাষার জন্য বাঙ্গালীর ঐতিহাসিক আত্মত্যাগকে। বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে মাতৃভাষার জন্য সেদিন যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, সে চেতনায় ধাবিত হয়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যতকাল লিখা হবে, পড়া হবে, বলা হবে, ততকাল বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে বার বার ফিরে ফিরে আসবে। মহান একুশের ৬৮তম বার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিরন্তর। (সমাপ্ত)

মোহাম্মদ বেলাল হোসেন ইতিহাস বিষয়ক গবেষণাকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট