চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

বিশে^র আলোচিত পবিত্র নগরী বোখারা

কালান্তরে দৃষ্টিপাত

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩৩ পূর্বাহ্ণ

উজবেকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী বোখারা। একাধিক দিক দিয়ে বিশে^ বোখারা নগরীর গুরুত্ব থাকলেও হাদীস শরীফ সংকলক ইমাম বোখারী ও তরিকতের ইমাম হযরত নকশবন্দ বাহাউদ্দিনের কারণে আমাদের দেশে এ নগরীর আলাদা গুরুত্ব। প্রায় ২ হাজার বছর পূর্বে জেরাভসন নদীর তীরে বোখারানগরীর গোড়াপতন। ইউরোপ থেকে এশিয়ায় বাণিজ্য পথের মিলন ক্ষেত্র হিসেবে বিজয়ীদের লোলুপ দৃষ্টির ক্রুর তথা নির্দয়, নিষ্ঠুর আক্রমণে বার বার ক্ষত বিক্ষত হয়। অষ্টম শতাব্দীতে আরবগণ বোখারা জয় করেন। বর্তমানে বোখারা নগরী দু’ভাগে ভাগ করা পুরাতন ও নতুন। পুরাতন বোখারায় জন্মগ্রহণ করেন সহীহ হাদীস শরীফ সংকলক হযরত ইমাম বোখারী (রহ.)। শুধু জন্মই নয় তাঁর জন্মস্থানের নিকটে বিশ^খ্যাত মাদরাসায় তিনি পাঠ দান করেন। অপরদিকে, বিশ^খ্যাত তরিকতের ইমাম তথা নকশবন্দীয়া তরিকার প্রবর্তক হযরত বাহাউদ্দিন (রহ.) বৃহত্তর বোখারার-ই বাসিন্দা। প্রকা- মাজার কমপ্লেক্স নিয়ে তিনি এখানে শায়িত।

বোখারায় রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস। ঐ সময় বোখারা পারস্য সা¤্রাজ্যের অধীনে ছিল। পরবর্তী সময়ে আলেকজান্দ্রা দি গ্রেটের নিয়ন্ত্রণে আসে। বোখারা দখল বেদখল নিয়ে ধ্বংসাত্মকের ইতিহাসও রয়েছে। হিজরি ১ম শতকে বোখারায় ইসলামের আলো পৌঁছে। আমিরে মোয়াবিয়ার আমলে খোরাশান ছিল একটি বৃহত্তর অঞ্চল। ঐ সময় খোরাসানের গভর্নর ছিলেন ওবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদ। তাঁর আমলে বোখারায় ইসলামের আলো পৌঁছে। হিজরি ১ম শতকের শেষের দিকে বুখারায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে তথা ৮ শত খ্রিস্টাব্দের দিকে সামানাবাদীদের রাজধানীর মর্যাদা পায়। তাদের যোগে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের নগরী হয়ে উঠে বোখারা। সেই সময় ইমাম বোখারী (রহ.)’র জন্ম হয়। অবশ্য ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বোখারা চেংগিস খানের ধ্বংসাযজ্ঞের স্বীকার হয়। এখানে চলে লুণ্ঠন, হত্যাযজ্ঞ ইত্যাদি। তারা এখানে প্রাসাদসহ নানান স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। এতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বোখারার গুরুত্ব কমে যায়। এ রকম চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ইসলাম আপন অবস্থায় বহাল থাকে। পরবর্তী মোঘলরা ইসলাম গ্রহণের পর শিল্প, সাহিত্য, রাজনৈতিক ও ইসলাম চর্চায় বোখারা আরও আলোচিত হয়ে উঠে। তৈমুর লং এর আমলেও বোখারা এগিয়ে যায়। সোভিয়েত রাশিয়া বোখারাসহ এ অঞ্চল দখল করে নেয়। এতে স্বাধীনভাবে ধর্ম কর্ম করা ও ইসলাম প্রচার এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। বোখারা ইসলামী জ্ঞান চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। সারা বিশ^ থেকে জ্ঞানার্জনের জন্য আসত এখানে। গড়ে উঠে বিশ^খ্যাত মাদরাসা। ইমাম বোখারী (রহ.)’র জন্মস্থানের অনতিদূরে বিশ^খ্যাত এ মাদরাসায় প্রায় ৭০ হাজার ছাত্র লেখাপড়া করতেন। বোখারার এ কেন্দ্রীয় মাদরাসা এত বিশাল ছিল যে, বোখারী শরীফের দরস নিত একসঙ্গে প্রায় ৪ হাজার ছাত্র। এ মাদরাসায় ইমাম বোখারী (রহ.) দীর্ঘদিন দরস দেন। বোখারায় রয়েছে ১৪০টির মত মিউজিয়ামে। দুই শতাধিক মাদরাসা।
পুরাতন বোখারা তার মিনার গম্বুজ, মসজিদ, মাদরাসা, বাজার দেখার মত। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বোখারা সমরকন্দের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তা স্থানান্তরিত হয়ে মধ্যস্থলে তাশখন্দের আওতায়। উজবেক শব্দে কালান বা কালোন অর্থ বড়। বোখারার বিখ্যাত এ মাদারাস কমপ্লেক্সের বর্ণনা দিতে গেলে এখানকার মসজিদটি পুনঃনির্মিত হয় ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে। এর সামনে বিশাল চত্তর বা মাঠ। অতঃপর বিশ^খ্যাত মাদরাসা।
ইয়ামেনের শেখ আবদুল্লাহ ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এ মাদরাসা পুনঃ নির্মাণ করেন। এখানে রয়েছে একপাশে তাদের সমাধি। মাদরাসা ও মসজিদের মাঝখানে মাঠ, মাঠের দক্ষিণ পাশে রয়েছে বিশ^খ্যাত মিনার। এটি নির্মাণ করা হয় ১১২৭ খ্রিস্টাব্দে। এ মিনারকে বোখারার গর্ব বলা হয়ে থাকে। যার উচ্চতা ৪৬ মিটার।

হযরত ইমাম বোখারীর জন্মস্থান হলেও নকশবন্দীয়া তরিকা ও তার আগেকার মহান ইমামগণ এ বৃহত্তর বোখারায় শায়িত রয়েছেন। অন্য দিকে খ্যাতিমান মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী, হযরত শেখ সাদী, মাওলানা আবদুর রহমান জামী প্রমুখ কবি সাহিত্যিকের লীলাভূমি বোখারা। অপরদিকে, ইবনে সিনা, আবু হাসজি, কবিরসহ মহান জ্ঞানীগুণীরা এখানকার সন্তান। হযরত খাজা আবদুল খালেক গজ দওয়ানী, হযরত খাজা আরেফ রেওয়াগারী (রহ.) হযরত খাজা মাহমুদ ইনজির ফাগনওবী (রহ.), হযরত খাজা আযিযান আলী রামিতিনি (রহ.) হযরত খাজা মুহাম্মদ বাবা সামমাসী (রহ.) হযরত ছৈয়দ আমীর কুলাল (রহ.) কে নিয়ে বোখারা গর্ব করে। বোখারা শহরের অনতি দূরে প্রায় ২০-৪০ একর এরিয়া নিয়ে এ মহান তরিকতের ৬ জন ইমাম শায়িত রয়েছেন।
আগেই অন্য প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি, রাশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভের পর উজবেকিস্তানের জনগণ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একভাগ পশ্চিমা স্টাইলের জীবনযাত্রাকে গ্রহণ করে নেয়। অপরপক্ষ তথা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা ব্যক্তিগণ। এদের মধ্যে সুফিজমের বিশ^াসী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে নকশবন্দীয়া তরিকায়। যেহেতু উজবেকিস্তানে অনেক তরিকতের ইমাম বিশাল বিশাল মাজার হযরত নকশবন্দ বাহাউদ্দীন (রহ.)’র আগে ও পরে। বৃহত্তর বোখারায় এ রকম ৮/১০ তরিকতের মহান ইমাম ২০/৩০ একরের এরিয়া নিয়ে শায়িত।

আগেই উল্লেখ করেছি বৃহত্তর বোখারা দু’ভাগে বিভক্ত। পুরাতন ও নতুন। তবে হযরত ইমাম বোখারী (রহ.)’র বাড়ির নিকটে তিনি যে মাদরাসায় পাঠদান করতেন সে মাদরাসা ও মসজিদ ই বোখারার অন্যতম ধর্মীয় মাধ্যম। গত নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে এ বোখারায় ৩ রাত অবস্থানকালে এখানে দুই রাতে এশারের নামাজ পড়ার সৌভাগ্য হয়। সাথে মাদরাসাসহ এ কমপ্লেক্স ঘুরে ফিরে দেখা। সোভিয়েত রাশিয়ার কঠোর শাসনের ফলে মুসলমানগণ যে ধর্মহারা হয়ে গিয়েছিল তা এখনও অন্যান্য মুসলিম দেশের মত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে বলা যাবে না।

বৃহত্তর বোখারায় এখানে সহ কতেক মসজিদে নামাজ পড়ার সুযোগ হয়। ইমামগণ ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী হলেও আমাদের দেশের মত তাদের ইমামগণের দাড়ি, টুপি, কাপড়ে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে এখনও দূরে। সমতল ভূমিতে বোখারা। পাহাড়-পর্বত দৃষ্টিগোচর হয় নি। মানুষ অমায়িক, ন¤্র, ভদ্র। ধার্মিক মহিলারাও ঢিলে ঢালা কাপড়-চোপড় পরিধান করে। মাথায় শক্তভাবে উড়না পরিধান করে। অর্থাৎ বোরকা পড়া মহিলা চোখে পড়েনি। বয়স্ক ধার্মিক মহিলারা অনেকে মাজার মসজিদ কমপ্লেক্সে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নসহ নানান সেবা প্রদান করে থাকে। বৃহত্তর বোখারায় এক মাজার মসজিদে জুমা পড়া হয়েছিল। এখানে একাধিক মহিলা মুসল্লিগণ ঘরে তৈরি পিঠা জাতীয় খাবার আনতেছে দেখলাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট