চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

অমর একুশে

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৮:২৯ অপরাহ্ণ

আবার এসেছে ফিরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। বায়ান্নের সেই ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি তথা ৮ই ফাগুনের পর ৬৮ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু অমর একুশের চেতনা আজও অমলিন। বাঙালি জাতির চির প্রেরণা ও অবিস্মরণীয় এই দিনটি আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে সেদিন বাংলার মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণের স্বজাত্যবোধের যেই মশাল প্রজ্বলিত করেছিলেন, সেই মশালের আলো আজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বপরিম-লে। জাতিসংঘ সেই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে। বাঙালি জাতি সেদিন যে ইতিহাস রচনা করেছিল, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্ব তাকে বরণ করেছে আজ সুগভীর শ্রদ্ধায়। সংগতকারণে বলতে হয়, একুশে ফেব্রুয়ারি শোকাবহ হলেও এর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় পৃথিবীর বুকে অনন্য। বাঙালি-জীবনে প্রতিবছর একুশে আসে নবজীবনের ডাক নিয়ে। একুশে ডাক দিয়া যায় উদ্দীপনের, উজ্জীবনের। প্রতি বছর মহান একুশে সবার কাছে এই বার্তাই দিয়ে যায়, অন্যায় ও অপশক্তির কাছে বাঙালি কখনো মাথা নত করেনি, করবেও না। একুশে আমাদের মননের বাতিঘর। আজ আমরা শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করি ভাষা আন্দোলনের জানা-অজানা সব শহীদকে।

একুশে আমাদের শাশ্বত এক বাতিঘর। বাঙালির আবেগ, ভালোবাসা, আত্মপরিচয়ের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া এক প্রেরণার উৎসের নাম। সংগত কারণে দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিমাঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী এই জনপদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির জাতিসত্তাকে পঙ্গু করে দেয়ার মহাপরিকল্পনা করেছিল। তারই অংশ হিসেবে তারা প্রথমে বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানে। কিন্তু এ অঞ্চলের জনগণ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। শুরু হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। একপর্যায়ে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায় পাকসেনারা। সেদিন মাতৃভাষা বাংলার সম্মান রক্ষার তাগিদে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন বাংলার দামাল তরুণরা। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে তাঁরা ঘাতকের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। শহীদ হন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারসহ অনেকে। তাদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা। সেদিন বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা ঘটেছিল, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। যার কারণে বলা হয়ে থাকে, একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির চির প্রেরণার প্রতীক, বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের সূতিকাগার।

মহান একুশে অনন্য মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে আছে বাঙালি জাতির মননের গভীরে। সংগ্রাম, সাধনা এবং চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে ভাষাশহীদরা নির্মাণ করে গেছেন এক আলোকিত পথ, যে পথ ধরে আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছে বাঙালি জাতির বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। একুশে আমাদের অপরিমেয় শক্তি-সাহস যুগিয়েছে। বলীয়ান করেছে অদম্য এক আত্মবিশ্বাসে। সকল দুর্যোগে-দুর্বিপাকে একুশেই আমাদের পথ দেখিয়েছে, দেখিয়ে চলেছে। বাঙালি ও বাংলাদেশ যতোদিন টিকে থাকবে, ততোদিন এর ব্যত্যয় ঘটবে না। কারণ, একুশের শিকড় আমাদের চেতনার গভীরে প্রোথিত। তাই জাতীয় ইতিহাসের এই দিনটি একদিকে স্মরণের অন্যদিকে উজ্জীবিত হবার। তবে, দুঃখজনক হলেও সত্য, একুশের চেতনার আলোকে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার পাশাপাশি মাতৃভাষার চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। আজ দেশ উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে অনেকটাই এগিয়েছে। কিন্তু একুশে সঙ্গে জড়িয়ে আছে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, সেগুলোর কি নিষ্পত্তি করতে পেরেছি আমরা? রাষ্ট্রীয় জীবনে অসাম্য, বৈষম্য, ধনী-দরিদ্র্যের ব্যবধান দূরীকরণ এবং দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য রোধ করা কি সম্ভব হয়েছে? অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও কূপম-ূকতা থেকে কি জাতি মুক্তি পেয়েছে? রাষ্ট্রের সর্বস্তরে কি বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা গেছে? ভাষার শুদ্ধ চর্চা কি হচ্ছে আমাদের মাঝে? আজ এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার?
উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে দেশকে কাক্সিক্ষত গতিতে এগিয়ে নিতে চাইলে একুশের চেতনার আলোকে সব প্রশ্নের যৌক্তিক ফায়সালা হওয়া দরকার। আমাদের জাতীয় শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সকল শুভ ধারার বিকাশে একুশের অন্তহীন প্রেরণাকে কাজে লাগাতে হবে। কাজে লাগাতে হবে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশেও। একুশের চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে হবে আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রেই। তবেই সম্ভব হবে একটি সুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া। আজকের এই দিনে আমরা মহান ভাষাশহীদদের প্রতি জানাই আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। শহীদ স্মৃতি অমর হোক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট