চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রসঙ্গ বাংলা ভাষার চির মর্যাদাকর আসন লাভ

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩৮ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সৌভাগ্য, প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাভাষা আজ বিশ্বের সর্বত্র আলোচনা ও অনুভবের বিষয়বস্তু। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষার জন্য রক্তদান স্মরণে বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। তাই দিবসটি এখন আর আমাদের দেশে নয়, সর্বত্র সমাদৃত ও পালিত হয়।

গোটা বাঙালী জাতির জন্য এ এক মূল্যবান ও গৌরবের প্রাপ্তি এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতির মাধ্যমে এ ভাষার মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বাংলা ভাষাভাষিদের দায়িত্বও বেড়েছে বহুগুণে। সকল মানুষের মায়ের ভাষা এবং বিশেষ করে আমাদের মাতৃভাষাকে সমুন্নত রাখার জন্য আমাদেরকে আরও বেশি নতুন উদ্দ্যমে কাজ করতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে এর গুরুত্ব। ফিতরাত বা স্বভাবধর্ম পবিত্র ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষার মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআন ও হাদীসের বেশ কিছু জায়গায় মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। সুরা রুমের ২২ নং আয়াতে বলা হয়েছে: আর তার (মহান আল্লাহর) নির্দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে আসমানগুলো ও পৃথিবী সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এর মধ্যে রয়েছে নিদর্শন জ্ঞানী ব্যক্তিদের জন্য। ইসলাম ধর্ম জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ও ভাষাপ্রীতিকে ব্যক্তিগত এবং জাতিগত মর্যাদার অংশ হিসাবে বিবেচনা করে।

বর্ণিত আয়াত থেকে বুঝা যায়, ভাষার বিভিন্নতা, লালিত্য কুদরতে ইলাহির এক বিষ্মকর লীলা। ভাষার বিভিন্নতার মধ্যে অভিধানের বিভিন্নতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বসম্প্রদায়ের ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে করে তারা তাদের কাছে প্রয়োজনীয় দাওয়াত সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে পারেন। (সূরা ইব্রাহীম-৪)। মাতৃভাষায় নবী-রাসুল প্রেরণের আল্লাহর এ দর্শন মানবজাতির কল্যাণকামিতারই পরিচায়ক। বলা বাহুল্য, যে ভাষায় মানবশিশুর মুখের কথা ফুটে, বেড়ে উঠে যার কোলাহলে, সে ভাষার সাথে বনী আদমের হৃদ্যতা ও সখ্যতা অবিচ্ছেদ্য। এ ভাষা মাত্রেই গর্বের। খোদ প্রিয় নবী (সা.)ও নিজ মাতৃভাষা আরবী নিয়ে এমন গর্ব করেছেন। তিনি বলতেন: আনা আফসাহুকুম….. আরবদের মধ্যে আমার ভাষা সর্বাধিক সুফলিত; তোমাদের চাইতেও আমার ভাষা অধিকতর মার্জিত ও সুললিত। কোন কোন আলিমগণ ভাষা নিয়ে এ জন্য গর্ব করাকে সুন্নাত হিসেবে অভিহিত করেছেন। মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করা মানে কোন জাতির অস্তিত্বকেই অস্বীকার করার শামিল। মাতৃভাষার প্রতি আল্লাহর রাসুলের (সা.) সম্মান প্রদর্শন ও গুরুতা¡রোপ আরব জাতির মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং দারুন আগ্রহের উম্মেষ ঘটায়। তাই আমরা দেখি, ইসলামের আবির্ভাবের পর প্রাথমিক যুগের আরবগণ যে সমস্ত দেশে গিয়েছিলেন সে সমস্ত দেশের মানুষের মুখের ভাষাকে তারা সম্মানের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। তারা কোথাও আরবী ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেননি শুধু ইসলামের মূলধারার বাহন হিসাবে পাশাপাশি আরবীর ব্যাপারেও উৎসাহ দিয়েছেন মাত্র। দিগি¦জয়ী আরবরা ইচ্ছা করলে তখন সে সমস্ত দেশে আরবী ভাষা প্রবর্তন করতে পারতেন। পারতেন বিজিত ভূ-খন্ডগুলোতে আরবীকেই একমাত্র সংস্কৃতির বাহন হিসাবে দাড়ঁ করাতে। কিন্তু তারা তা করেননি। প্রতাপী আরব সেনাদল মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্থান বিজয়ের পর সে অঞলে তুর্কীভাষাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্টিত করেছিলেন। এভাবে মালয় ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশেও স্থানীয় ভাষাকে মর্যাদা দান করেন। এর কারণ হলো ইসলাম কখনো কল্যাণপ্রদ ও মানবচাহিদাকে অবমূল্যয়ান করতে চায়না। বরং যে কোন অনুপম ঐতিহ্যের স্বীকৃতিদানের চেষ্টা চালায়।

একইভাবে বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখব, বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে এদেশের মানুষের ভাব প্রকাশের ভাষা ঋজুতার বৈভবে সংঘটিত হতে থাকে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রাদি.) এর খিলাফতকালে আনুষ্ঠানিকভাবে এখানে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। ইশাআত ও তাবলীগের যারা তৎকালীন মুবাল্লিগ ও প্রচারক ছিলেন তাদের ভাষা ছিল উর্দু ও ফার্সি। এখানে এসে তারা বাংলার সাধারণ মানুষের দ্বারে গেলেন। রপ্ত করলেন স্থানীয় ভাষা। সে ভাষাতেই শোনানোর প্রয়াস পান তাওহীদের মর্মকথা। কুরআনুল কারীমে যথার্থই ইশারা করেছে উদউ ইলা সাবিলী রাব্বিকা…
তোমার প্রভূর রাহে মানুষকে আহ্বান কর হিকমত ও উত্তম কথামালার মাধ্যমে।’ বাংলাভাষার ইতিহাসের সূচনাকাল হিসেবে পন্ডিতরা ৬৫০ খৃঃ নির্ধারণ করেছেন। স্বভাবতই দেখা যায় ৬৫০ খৃষ্টাব্দের বেশ কয়েক যুগ পূর্ব থেকেই এখানে ইসলাম প্রচারের শুভসূচনা হয়েছিল। তখনকার যুগের এদেশের রাজাগণ ও তথাকথিত অভিজাত শ্রেণী যে ভাষাকে ইতর জনের ভাষা হিসেবে দূরে ঠেলে রেখে ছিল মুসলমানেরা তা সম্মানের সাথে লালন করেন। ১২০১ খৃষ্টাব্দের পরে বিশেষ করে সুলতানী আমলে বাংলা ভাষাকে অধিক পরিমাণে মর্যাদা দানের চর্চা শুরু হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশির বির্পযয়ের পর এ ভাষার উপর হামলা হলো। এর অব্যবহিত আগে এবং পরে এ ভাষাকে বুকে ধারণ করে রেখেছিলেন যে ক’জন মুসলিম মণীষী তাদের মধ্যে আবদুল হাকিম, সৈয়দ সুলতান, কায়কোবাদ, কবি নজরুল, মীর মোশারফ হোসেন ও বেগম রোকেয়াসহ আরো অনেকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অন্যভাবে বলা যায় এদেশীয় সাহিত্যের উপর ইসলামের প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও সুদূরপ্রসারী। এর শব্দ ভান্ডারে তিন হাজার এরূপ শব্দ রয়েছে যা ইসলামের সাথে সাথে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে। যেমন হাতেমতাই দানশীলতার জন্য, কারুণ (কৃপনের জন্য), এজিদ (পাপিষ্ঠের জন্য), সীমার (পাষন্ডের জন্য) ব্যবহৃত হয়। মুসলমানদের জন্য এটি অবশ্যই গর্বের। কিন্তু কতিপয় আত্মভোলা মুসলিম গোষ্ঠি এ ব্যাপারে বে-খবর।

বাংলা ভাষা আজ অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও সমৃদ্ধ। এ ভাষায় সেবা করে যাচ্ছেন অসংখ্য জ্ঞানী গুণী পন্ডিত, কবি সাহিত্যিক। একইসাথে মুসলিম স্কলারদের একটি বিশাল গ্রুপ ইসলামের মূল্যবান গ্রন্থরাজি এ ভাষায় রচনা করে কিংবা অনুবাদ করে একই সাথে বাংলা ভাষার মাধুর্য ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার ধারাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। আজ আমাদের কত না সৌভাগ্য।
বাংলা ভাষায় রয়েছে কুরআনের অসংখ্য তাফসীর। বিশুদ্ধ হাদীস শরীফের অনেক ব্যাখ্যা গ্রন্থ। দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান ও মাসলা মাসায়িল জানার জন্য বাংলায় অনূদিত হয়েছে নানা ফিকহ গ্রন্থ, ছড়িয়ে পড়েছে আধুনিক ধর্মীয় পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিন। আজ মাতৃভাষায় ইসলাম সম্পর্কে নানা যুগজিজ্ঞাসার জবাব সহজ প্রাপ্তিতে বাড়ছে মুসল্লির সংখ্যা, কমেছে নানা ধর্মীয় ফিরকাবাজি ও ফতোয়াগিরি। এজন্য আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার প্রতি অশেষ কৃতার্থ। আসছে ২১ ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমাদের উচিত এ উপলক্ষে বাংলা ভাষার মহিমা আমাদের মসজিদ মক্তব, পারিবারিক বলয়ের সন্তানদের কাছে স্পষ্ট করা।

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট