চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনাভাইরাস আতঙ্ক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি

মো. দিদারুল আলম

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩৮ পূর্বাহ্ণ

চীনে মহামারী রূপ নিয়েছে করোনো ভাইরাস। উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজারের মতো। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দমনে উহান শহরের বিমানবন্দর ও রেলস্টেশনগুলো অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, থাইল্যান্ড, হংকং ও ব্রিটেনসহ ২৪টি দেশে ১৫১ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ লক্ষ্য করা গেছে। এই তালিকা রয়েছে ভারতও।

এদিকে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকটে জরুরি অবস্থা জারির পর বিশ্বের অনেক দেশ চীন থেকে আসা মানুষদের প্রবেশে নজিরবিহীন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। চীন দেশের বাইরে দুই জনের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত প্রাণহানি ঘটেছে, অসুস্থ হয়েছে অনেকেই। এই মুহূর্তে চীনের জন্য জরুরিভিত্তিতে মেডিকেল মাস্ক, সুরক্ষা স্যুটস এবং চিকিৎসকদের নিরাপত্তা চশমা দরকার। গুয়াংডং-সহ দেশটির যেসব প্রদেশের বাসিন্দা ৩০ কোটির বেশি, সেসব শহরে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর প্রত্যেকের জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু দেশটির কারখানাগুলোর দিনে মাত্র ২ কোটি মাস্ক তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। তবে বিশে^ অনেক দেশ তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। এই সুযোগে আমাদের দেশেও মাস্কের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে দেশের ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ থেকে রফতানিজাত বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামালের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে চীন থেকে। কিন্তু বর্তমানে এসব কাঁচামাল আমদানি বন্ধ। পূর্বের আমদানি করা মজুদ থেকে এখন চললেও সেটা কিছুদিনের মধ্যে ফুরিয়ে যাবে। আবার বড় বড় অবকাঠামোতে উন্নয়ন কাজের ঠিকাদার প্রকৌশলীসহ যন্ত্রপাতিও আমদানি করা হয় চীন থেকে। এসব প্রকল্পের কাজও বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমতাবস্থায় আমদানির ক্ষেত্রে চীনের বিকল্প বাজার হিসেবে সরকার ও ব্যবসায়ীদের এখন্ই বিকল্প দেশ খুঁজতে হবে, অন্যথায় বাজার সামলে দেয়ার ক্ষমতা থাকবে না।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন- এই করোনা ভাইরাসের কারণে চীনের পরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশ চীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না এলে অনেক খাতের পণ্য, কাঁচামাল সময়মতো আমদানি করা যাবে না। ফলে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ কমে যেতে পারে। আবার রফতানিও ব্যাহত হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের বড় অংশিদার চীন। এসব প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় পাঁচ লাখ চীনা নাগরিক কাজ করে। যার বড় অংশ ছুটি কাটাতে চীনে অবস্থান করছেন। এসব ব্যক্তি সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসাসহ সামগ্রিক বিবেচনায় ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত।
পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেলওয়ে সংযোগ, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণসহ বড় বড় প্রকল্পের কাজ করছে চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে, অনেকগুলো শুরুর পর্যায়ে। জানা যায়, এসব প্রকল্পে কাজ করে এরকম প্রায় দুই’শ চীনা নাগরিক দেশে গিয়ে আটকে গেছেন। যারা এখন আর ফিরতে পারছেন না। বাংলাদেশের বস্ত্র খাতের প্রাথমিক কাঁচামাল, সুতা, শিল্প কারখানার মেশিনারিজ, রাসায়নিকসহ বিভিন্ন পণ্য চীন থেকে আমদানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। যা ওই অর্থবছরের মোট আমদানির ২৬ দশমিক ১ শতাংশ। এই আমদানির প্রায় ৭০ শতাংশ বস্ত্র, মেশিনারী, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য।

ভাইরাসটি নিউমোনিয়া ধরনের অসুস্থতা সৃষ্টি করে এবং তারপর অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসায় সাড়া দেয় না। ভাইরাসটিতে সংক্রমণের লক্ষণ হচ্ছে সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা। এছাড়া জ্বর ও মাথাব্যথাও হতে পারে। এসব সমস্যা কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের মানুষ, বয়স্ক ও শিশুদের এই ভাইরাসে নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কাইটিসের মতো শ্বাসনালীর সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে বিপদ এ কারণে যে, এর নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো আপনা আপনি চলে যায়। চিকিৎসকরা ব্যথা বা জ্বরের ওষুধ দিয়ে উপসর্গগুলো থেকে আপনাকে মুক্তি দিতে পারেন। গরম পানিতে গোসল গলাব্যথা বা কাশি থেকে মুক্তি দিতে সহায়ক হতে পারে।
এ সময় প্রচুর তরল পান করুন, বিশ্রাম নিন এবং পর্যাপ্ত ঘুমান।

রোগের উপসর্গগুলো যদি সাধারণ ঠান্ডার তুলনায় বেশি কিছু বলে মনে হয় তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
নতুন করোনা ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য কোনো ভ্যাকসিন নেই। অন্তত এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। মার্স ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট নতুন করোনা ভাইরাসটির ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ করছে। কিন্তু ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগে যেতে পারে। সচেতন থাকাটাই মূল বিষয়। হাঁচি ও কাশি দেওয়ার সময় নাক ও মুখ ঢেকে রাখুন। বাইরে বেরোনোর সময় মাস্ক ব্যবহার করুন। পোষা প্রাণি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে এবং সংক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। অনেক সময় এটি মানুষের জন্যও প্রাণঘাতী রোগের কারণ হতে পারে।

চীনের অভিযোগ, ভাইরাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। চায়না নববর্ষের ছুটি শেষে প্রায় দশ দিন পর লেনদেন শুরু হয়েছে দেশটির শেয়ারবাজারে। তবে প্রথমদিনেই বড় ধসের মুখে বাজার। সূচকের পতন হয়েছে প্রায় আট শতাংশ। যা গেলো চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এছাড়া চীনে ব্যবসা পরিচালনা সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ সঙ্কটে চীনের আর্থিক ক্ষতি ৬ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম। ক্ষয়ক্ষতি কমাতে দেশের অর্থনীতিতে আরো ২ হাজার ২শ’ কোটি ডলার যোগ করতে যাচ্ছে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মো. দিদারুল আলম প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট