চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রসঙ্গ চিকিৎসকদের পেশা পরিবর্তন

চিকিৎসা শ্রমিকের দিনলিপি

ডা. হাসান শহীদুল আলম

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৪:২৭ পূর্বাহ্ণ

মাঘের তৃতীয় সপ্তাহ। ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। পটিয়াস্থ চেম্বার। ইদানীং স্বাস্থ্যক্যাডার ত্যাগ করে চিকিৎসকগণ অন্যান্য ক্যাডারে যোগদান করছেন এমনি ধরনের তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে। ৩৩তম বিসিএস থেকে মহিলাচিকিৎসক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব হিসেবে যোগদান করেছেন। ৩৫তম বিসিএস-এ জনৈক চিকিৎসক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছেন এবং সহকারী পুলিশ সুপার পদে যোগদান করেছেন। ৩৬তম বিসিএস-এ কুমিল্লা নিবাসী জনৈকা মহিলাচিকিৎসক বিসিএস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। ৩৭তম বিসিএস-এ নারীদের মধ্যে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে জনৈক মহিলাচিকিৎসক বর্তমানে বিসিএস প্রশাসন-এ সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগদান করেছেন। এছাড়া আরো চিকিৎসক প্রশাসন ও পুলিশসহ অন্য ক্যাডারে যোগদান করেছেন।
আমরা ধরে নিতে পারি যে, চিকিৎসক হিসেবে দেশ ও জাতির কাছে তাঁদের দায়িত্বের কথা তাঁরা বিস্মৃত হন নি। বরং সেটা স্মরণে রেখেই তাঁরা মান-সম্মান নিয়ে দেশসেবা করতে পারার জন্যই উক্ত পদক্ষেপসমূহ নিয়েছেন। আমরা অঙ্গীকার করতে পারবো না যে, তাঁদের এমনি পদক্ষেপসমূহ গ্রহণের পেছনে রয়েছে বঞ্চনা, অবহেলা, সামাজিক অবমূল্যায়ন, দৈহিক লাঞ্ছনা, মানসিক নির্যাতন, অপমান ও দাসসুলভ অবিচারজনিত দীর্ঘশ^াস এবং অভিশপ্ত বেকার জীবনের গ্লানি। এ প্রসঙ্গে ফেসবুকে দেয়া নি¤েœর স্ট্যাটাসসমূহ পাঠক সমীপে তুলে ধরছি। :

ক)‘কুমিল্লার বাতকান্দি বাজারে আমার গাড়ী গৌরীপুরের দিকে যাচ্ছিলো। রাজনৈতিক দলের একটি মিছিল উল্টো দিক থেকে হোমনার দিকে যাচ্ছিলো। আমার ড্রাইভার গাড়ীটা ব্রেক করে থামাতে থামাতে দুয়েক মিনিট দেরী হলো। এই দুয়েক মিনিট দেরী হবার অপরাধে আমার গাড়ীতে সামনে লাঠি দ্বারা আঘাত করলো। আমার গাড়ীর সামনে পেছনে ডাক্তার এর চিহ্ন লাল চাঁদ আছে। আমি গাড়ী থেকে নেমে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক বলে পরিচয় দিলাম। কোন কাজ হলো না। একজন এসে গাড়ীতে লাঠি দিয়ে পুনরায় আঘাত করলো। আমি তাদের কোন একজন পাতি নেতাকে খুঁজে বের করলাম। তাকে ব্যাপারটা বললাম। সে অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললো, আমি কেমন ডাক্তার….. এর সম্মেলন হচ্ছে, আর আপনি গাড়ী চালিয়ে আমাদের মিছিলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন? আমি বললাম, আমি তো দেশের বাড়ী থেকে আসছিলাম,…. আজকের প্রোগ্রাম সম্পর্কে আমার জানার কথা না। সে বললো ‘তাড়াতাড়ি আপনার গাড়ীটা পাশের গলিতে ঢুকান। নইলে আমার কর্মীরা আপনার গাড়ী ভেঙ্গে ফেলতে পারে। সেইমতে আমার ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলাম। গাড়ী গলিতে ঢুকিয়ে ফেললো। আমি দাঁড়িয়ে ….. দলের হোনডা মিছিল দেখতে লাগলাম। এক মিনিট পরেই একজন বললো, ‘তোমরা সবাই সাইড দিয়ে মাঝখানে রাস্তা খালি করে দাও। দেখলাম পুরো রাস্তা খালি করে হোন্ডার মিছিল দুদিকে চেপে এসপি-ডিসিকে কুমিল্লা যাবার পথ করে দিলো। আমার ড্রাইভার আমাকে বললো, স্যার, আপনারা কি এতো ছোট চাকুরী করেন যে, আপনার গাড়ীতে আঘাত করতে আসলো, আর এসপি/ডিসি এর নাম শুনেই রাস্তা কিলিয়ার করে দিলো? আমি ড্রাইভারকে বললাম, আমরা জয়েন্ট সেক্রেটারী লেভেলের কর্মকর্তা, এসপি/ডিসিরা ডেপুটি সেক্রেটারী লেভেলের অফিসার। এরা বাঁধতেও পারে (এসপি), আবার ছুটাতেও (ডিসি এডমিন) পারে। আর এসপি/ডিসিরা যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারের পক্ষে …. বিশেষ ভূমিকা রাখে। আমাদের মতো চিকিৎসকদের সেখানে কোন দায়িত্ব থাকে না Ñ এই জন্যেই (জনৈক অধ্যাপক চিকিৎসক, ডাক্তার প্রতিদিন ডটকম।)”

খ) ‘সিলেট উইমেন্স, মেডিকেল কলেজের আজকের দুপুরের ঘটনা। ইউরোলজি এর এক প্যাশেন্ট আসলো। ডিউটি ডাক্তারের অনুরোধে আমি গেলাম পাশেন্ট রিসিভ করতে। কারণ আমার এডমিশান ছিলো। গিয়ে দেখি প্রায় ১৫/১৬ জন ছেলে সাথে আছে। প্যাশেন্ট এর হিস্ট্রি নিতে নিতে খুব বিনয়ের সাথে বললাম, আপনারা একজন থাকুন, বাকিরা বেরিয়ে যান। একজন বললেন, আমাদের সামনেই ট্রিটমেন্ট দেন। আমি বললাম, প্যাশেন্টকে এক্সপোজ করতে হবে। আর হসপিটালের তো একটা প্রটোকল আছে। তারা বললেন, তারা সবাই থাকবেন এবং সবার সামনেই ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। তারপর এদের মধ্যে একজনের অনুরোধে বাকিরা বেরিয়ে গেলেন। তিনজন দাঁড়িয়ে থাকলেন। প্যাশেন্টকে এগজামিন করতে করতে আবার মানুষ ঢোকা শুরু করলো। আমি তখন বললাম, ‘ দেখুন, আপনাদের আমি বার বার বলেছি আপনারা একজন থাকুন, বাকিরা বেরিয়ে যান।’ যথেষ্ট বিনয়ের সাথে বললাম। তখন এদের মধ্যে একজন বললো, ‘তোমার এমডিকে আমি কান ধরে এনে দাঁড় করাবো। ক) ট্রিটমেন্ট।’ আমি তখন বললাম ‘কি বললেন আপনি?’ সে বললো (আঙ্গুল উচিয়ে), ‘কিছু বলি নাই, প্যাশেন্ট-এর প্রেসিডেন্ট। ট্রিটমেন্ট দাও। আমি বললাম, ‘দেখেন ক্ষমতাধর ব্যক্তির জন্য ট্রিটমেন্ট, আপনার প্যাশেন্ট এর জন্যেও একই ট্রিটমেন্ট। সবাইকে আমরা একইভাবে চিকিৎসা দেই এবং সবার জন্য একই নিয়ম। সুতরাং আপনাদের বের হতে হবে।’ এর মধ্যে আমি প্যাশেন্ট এর ব্লাড প্রেশার মাপা শুরু করে দিয়েছি। তখন তিনি আমাকে তুই-তুকারি শুরু করলেন। আমি আর সহ্য করতে না পেরে কান্না করতে করতে সিএ, ইনডোর, মেডিকেল অফিসার-এর রুমে গিয়ে ভাইয়া-আপুদের ঘটনা জানাই। তারপর সেই ছেলে আমার পিছন পিছন এসে কোমর থেকে ছুরি দেখিয়ে বলে, ‘তোর সাহস কতো? লাশ ফেলে দেবো।….. বাইরে বের হ একবার।…. করে ফেলবো। আমার পা ধরে তোকে মাফ চাওয়া লাগবো…. আরো অকথ্য ভাষায় গালাগালি। তারপর সিএ ভাইয়ের গায়ে হাত তোলার উপক্রম করে। এই হলো একজন ডিউটি ডক্টর এর নিরাপত্তার অবস্থা। আমরাও রোযা রাখি। আমাদেরও ক্লান্তি হয়, ক্ষুধা লাগে। কিন্তু প্যাশেন্টের প্রতি এসবের কোন আঁচ পড়তে দিই না। এতো ঘটনার মধ্যেও প্যাশেন্টের কাগজপত্র শক্ত করে আমার হাতে ধরা ছিলো। তার ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়েছে। কোথায় আমাদের নিরাপত্তা? রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে আমরা কতকাল জিম্মি থাকবো (জনৈকা নারী ইন্টার্ন ডাক্তার, ৯-৫-১৯ প্রতিদিন ডট.কম)?’
গ) ‘রুমের বাইরে তখনও জনা ত্রিশেক নারী-পুরুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের ভিতর আমি একের পর এক রোগী দেখে চলেছি। এমন সময় রুমে দু’জন ষ-া মার্কা লোক ঢুকে ফটোকপি করা প্রায় অর্ধশত কাগজ আমার সামনে ফেলে সত্যায়িত করে দেয়ার জন্যে জোরাজুরি শুরু করলো। মূল সার্টিফিকেটসহ দুপুর একটার পর আসতে বলেছিলাম। কাজের কাজ কিছুই হয় নি। ষ-াগুলোর রুদ্রমূর্তি দেখতে হয়েছিলো। যেভাবে এই লোকগুলো আমার রুমে ঢুকে আমাকে থ্রেট দিয়ে কাজ আদায় করতে চাইলো, একই রকম কি এরা ইউএনও বা এসিল্যান্ড বা এএসপি’র রুমে গিয়ে দেখাতে পারবে? (্জনৈকা উপজেলা মেডিকেল অফিসার, ২৬-১০-১৭ ডাক্তার প্রতিদিন ডটকম)?
উল্লিখিত ফেসবুক স্ট্যাটাসসমূহ বিশ্লেষণ করলে দুটো ব্যাপার পরিষ্কার হয়Ñ বর্তমানে সামাজিকভাবে চিকিৎসকগণ অবমূল্যায়িত এবং কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীন। এছাড়া আরো যে সমস্ত কারণে চিকিৎসা পেশার প্রতি চিকিৎসকগণ আকর্ষণ হারাচ্ছেন এবং অন্যান্য ক্যাডারে চলে যাচ্ছেন সেগুলো পরবর্তী লেখাসমূহে বিস্তারিত থাকবে। আজকের চিকিৎসক হয়ে অন্য পেশায় গেলে কি ক্ষতি হয় সে ব্যাপারে আলোকপাত করে লেখার ইতি টানছি।
এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জন করার পর যদি কেউ এই জ্ঞানকে পেশাগত কাজে না লাগিয়ে অন্য পেশায় যান সেটা তিনি যেতে পারেন, সেটা উক্ত চিকিৎসকের ব্যক্তি স্বাধীনতা। কিন্তু কথা থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির পেছনে সরকারের বিনিয়োগ বা জনগণের ট্যাক্সের টাকা এবং অভিভাবক ঘাম ঝরানো সঞ্চয় সব ক্ষতি বা লস এর খাতায় গেলো। উপরন্তু উক্ত চিকিৎসকের জায়গায় যদি আর একজন ছাত্র এই সুযোগটা পেতো, তাহলে জাতি তার কাছ থেকে কিছু হলেও সার্ভিস বা সেবা পেতো। বস্তুত প্রশাসনিক ক্যাডারে চাকুরী করার জন্যে এতো কঠিন কঠোর প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন এবং জীবন অনুসরণের প্রয়োজন পড়ে না। তাই চিকিৎসক এবং অন্যান্য টেকনিক্যাল ক্যাডারের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তাদের বিশেষায়িত সেবা দানের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে, যথাযথ সম্মান ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের ব্যর্থ হওয়া দেশ ও জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়।

ডা. হাসান শহীদুল আলম ডায়াবেটিস এবং চর্মরোগে ¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট