চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

একুশ আমার অহংকার

গোপাল নাথ বাবুল

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৪:১৬ পূর্বাহ্ণ

প্রতিবছর ঘুরে ফিরে আসে ভাষা আন্দোলনের মাস ও রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি মাস। এ মাস জুড়ে সারাদেশে ধ্বনিত হয় প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর সংগীতের অমিয় বাণী ‘আমার ভাই এর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে মাতৃভাষার মান রক্ষার্থে ৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তাদের।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বৃটিশ ড্রাফ্টম্যান র‌্যাডক্লিফ হিন্দু-মুসলমান দেখে দেখে পেন্সিলের ডগা দিয়ে অভিভক্ত ভারতের বিশাল মানচিত্র কেটে কেটে দুই ভাগ করে ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত নামের দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার পরই শুরু হয় বাঙালি জাতির উপর পাকিস্তানিদের বৈষম্য ও অকল্পনীয় অত্যাচার। মূলতঃ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, কোনোদিকেই পশ্চিম পাকিস্তান তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সমকক্ষ ছিল না। তাই পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিহিংসাপরায়ণ শিক্ষাবিবর্জিত শাসকগোষ্ঠি সুযোগসন্ধানী ঢাকার নবাব পরিবারকে হাতে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে তুলতে চেয়েছিল ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা। সেই হিসেবে তারা সর্বপ্রথম আঘাত হানে বাঙালির প্রাণের মাতৃভাষা বাংলার উপর। কারণ তারা জানতো, একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে সর্বপ্রথম সে জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হবে।

১৯৪৮ এর মার্চ মাসে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর ও জাতির পিতা কায়েদে আজম জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার মাধ্যমে যখন রক্তচোষার দল মায়ের ধ্বনি, মায়ের সুর, মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চায়, তখন তিতুমীর, সূর্যসেন, প্রীতিলতার বাংলার দামাল ছাত্র-জনতা গর্জে উঠে। এই গর্জনই ছিল ্ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ ও জাতীয় চেতনার প্রথম উম্মেষ। এর জেরে ৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে প্রতিরোধ গড়ে তুলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির তল্পীবাহক পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, জব্বার, রফিক, শফিক ও বরকতসহ নাম না জানা অনেকে। পৃথিবীতে ৫০০০ মাতৃভাষার মধ্যে আর কোনো ভাষা নেই, যে ভাষার জন্য কোনো দেশের মানুষ অকাতরে হাসতে হাসতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। একমাত্র বাঙালিরাই সেই গর্বিত জাতি। তারই পথ ধরে বাঙালি স্বাধীকার আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়ে ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮ এর স্বৈরচারি আয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যূত্থান পাড়ি দিয়ে নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মূলতঃ স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপন করা হয়েছিল ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময়।

বাংলার মানুষের দেশপ্রেম, মাতৃভাষাপ্রীতি, ও আত্মত্যাগের প্রতি বিশ্ববাসীর অকুন্ঠ স্বীকৃতি আত্মজাতিক মাতৃভাষা দিবস। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি তথা ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা জাতি হিসেবে আমাদের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। বাঙালির বীর সন্তানদের ভাষার জন্য আত্মত্যাগের কথা স্মরণে রেখে বিশ্বের প্রত্যেক জাতির মধ্যে স্ব-ভাষার প্রতি মমত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

পরিশেষে বলা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কারণে বাঙালি হিসেবে এদেশের প্রতিটি মানুষ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মানিত হয়েছে। আমরা এ দিবসের তাৎপর্যকে উপলব্ধি করে মাতৃভাষার শ্রী বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে সচেষ্ট হবো-এটাই হোক সবার কামনা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট