চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মৃতিতে ঘাসফুল’র প্রতিষ্ঠাতা পরাণ রহমান

হোমায়রা কবির চৌধুরী শিমুল

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৭:১৯ পূর্বাহ্ণ

ঘাসফুল-প্রতিষ্ঠাতা পরাণ রহমান ছিলেন সত্যিকার অর্থে আলোর বিকশিত শিখার মতো। লিখনি দিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে এই শব্দটি বেরিয়ে গেল। নারীকে পরাণ রহমান আলোক শিখার মতো করে তুলে ধরেছেন সমাজে। উনার হাত ধরেই অনেক নারী আজ আলোকিত, বিকশিত। আমার পেশাগত জীবনের হাতে খড়ি পরাণ আপা।

১৯৯৩ সাল আমার ছেলে কেজিতে পড়ে। আমার মনে হলো কিছু করা দরকার। বান্ধবী তুরানী বলল, ঘাসফুলের পরান আপার সাথে দেখা কর। আমার মা’সহ আমি গেলাম তখনকার ঘাসফুল এর হেড অফিস নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে। আমরা অফিসে বসলাম। শফি এসে বলল, আপনাদেরকে বাসায় আসতে বলছে। আমরা বাসায় গেলাম। দেখলাম ব্যক্তিত্বময়ী হাসিখুশী সুন্দরী আলোর দিশারী এক মহিলা। আমাদেরকে বসালো, সাদর আপ্যায়ন শেষে অনেকক্ষণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন। আমার মা-কে তিনি খুব আপন করে নিলেন। আমার জীবন-বৃত্তান্ত দেখে বললেন, সমাজতত্ত্ব আমার প্রিয় বিষয়। সেই থেকে আমার ঘাসফুলে যোগদান।

পহেলা এপ্রিল ১৯৯৩ হতে ঘাসফুলের চট্টগ্রামের ছোটপুল এলাকার ‘ইউনিট-৩’ এর ম্যানেজার হিসাবে যোগদান করলাম। মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, দলগঠন, সঞ্চয় ও ঋণ দান কর্মসূচী বস্তিবাসীদের নিয়ে আমাদের কাজ। আমার সঙ্গে প্রায়সময় পরাণ আপা বস্তিতে যেতেন। একবার তাঁর সাথে হাজীপাড়া এক বস্তিতে গেলাম। তখন ভরা বর্ষাকাল। চারিদিকে ময়লা-কাদা। পরাণ আপা একটা পিড়ি নিয়ে বসে গেলেন এক বাসায়- দেখে আমি অবাক। সবাই ব্যস্ত হয়ে বললো, আপনি এই ময়লা জায়গায় বসবেন না, আমরা চেয়ারের ব্যবস্থা করছি। আপা তার উত্তরে বললেন ‘আমি এখানেই বসবো’। যেখানে তোমরা অহরহ বসতে পারো সেখানে আমি কেন পারবো না। তোমাদেরকে নিয়েইতো আমি! আমি বুঝে নিলাম. ওনার মনটাই হচ্ছে তৃণমূলের এই নারীদের উন্নয়ন। ওনার মতো মানুষের সাথে সময় কাটানো জীবনের এক শিক্ষণীয় বিষয়। ঘাসফুল তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী দ্বারা গর্ভবতী ও প্রসুতিসেবা প্রদান করতো। এই ধাত্রীরাই ছিল ওনার সবচেয়ে কাছের মানুষ, আপনজন। সবসময় ধাত্রীদের খোঁজখবর নেওয়া তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, বিয়ে-শাদীতে সহযোগিতা করা এটাই ছিল যেন ওনার একটি আনন্দেরই অংশ। একবার ধাত্রী মোর্শেদা বেগম এক প্রসুতি মায়ের যমজ বাচ্চা প্রসব করালেন। মা ও বাচ্চা উভয়ই সুস্থ আছেন- আপাকে বললাম। উনি অফিসে এসে মোর্শেদাকে ডাকলেন এবং তাকে জড়িয়ে ধরলেন। আজ প্রতিটি মুহূর্তে যেন অনেক কিছুই শিখছি, তার অনুপস্থিতিতেও।
১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত আমি ঘাসফুল ও পরাণ আপার সঙ্গে এমনভাবে জড়িত হয়ে গেলাম। কখনও মনে হয় নাই উনি আমার উধ্বর্তন কেউ, বরং সবসময় মনে হয়েছে তিনি আমাদের সকলের মাতৃময়ী মমতাময়ী এক মা। এই পর্যন্ত ওনার মায়ের মমতা, শাসন, স্নেহ, প্রতিটি আদর্শ-ই আমাকে পারিবারিক, পেশাগত, সামাজিক, কর্মকা-, সেবাধর্মী প্রতিটা কাজে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে ও বাস্তববাদী হতে শিখিয়েছে।

মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় উনি জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন। এমনকি রাস্তায় চলাফেরার সময় যদি কোন দু:স্থ শিশু বা মহিলা দেখতেন তিনি টেক্সী থামিয়ে তাদের খোঁজ খবর নিতেন। প্রতিষ্ঠানের নাম যেমন দিয়েছেন ঘাসফুল, তেমন কাজগুলি ছিল ঘাসফুলকে নিয়ে। যে ফুল পায়ে পদদলিত হয় কেউ তার খোঁজ নেয় না। কিন্তু এই ফুলকে অর্থাৎ সমাজের অবহেলিত জনগণকে তিনি কাছে টেনে তাদের উন্নয়ন তথা দেশের উন্নয়ন সাধনের স্বপ্ন নিয়ে একটা সুন্দর জাতি গঠনের অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন। ওনার সম্পর্কে লিখতে গেলেই চোখ অশ্রু সজল হয়ে যায়। মনে হয় কি যেন হারিয়ে ফেলেছি। যদিও এইসব মানুষ হারায় না, তারা মৃত্যুর পরেও প্রেরণা হয়ে থাকে। ট্রেনিং, ওয়ার্কসপ, মিটিং সেমিনার সব জায়গায় তিনি আমাকে সংগে নিয়ে যেতেন, এমনকি বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন সব জায়গায় নিয়ে যেতেন এবং আমার পরিচয় দিতেন “বান্ধবীর মেয়ে”। ওনার স্মৃতি লিখতে গেলে শেষ করা যাবে না। ওনার বাসায় গেলে প্রায়সময় দেখতাম সমাজের বঞ্চিত, অবহেলিত, নিগৃহিতদের অবস্থান, কেউ আসছে চিকিৎসাসেবা নিতে কেউ বা অন্য সাহার্য্য নিতে। ওনার ফ্ল্যাটে দেখা যায় ২/৩ জন শিশু সবসময় পড়ালেখা করছে। তিনি ব্যতিব্যস্ত থাকতেন; দরিদ্র পরিবারের শিশু সোহেল, জুয়েল এদেরকে স্কুলে ভর্তি করানো কিংবা এতিমখানার কোন বাচ্চা ভর্তি করানো। কখনও বা দেখা যাবে স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠিত হয়ে ওনার সহযোগিতা নিতে আসে কোন নির্যাতিত নারী। আপা এসকল নির্যাতীতাদের প্রথমে সুপরামর্শ দিতেন, যদি তাতে ইতিবাচক কিছু না হয় তখন তিনি নিজ খরচে আইনী সহযোগিতার ব্যবস্থা করে দিতেন।

পরান আপা ছিলেন একজন বৃক্ষপ্রেমী। গাছ লাগানো চারা বিতরণ, শিশুদের চড়ঃ-চষধহঃ শিখানোসহ ওনার সদা চিন্তা থাকতো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। পরিবেশ যেন ভারসাম্য না হারায়। একবার এক জায়গায় গিয়েছি সেখানে অনেক গাছ ও ফুল। আপা তার স্বভাবসূলভ বলল, এখান থেকে কিছু চারা নাও। আমি বললাম, আপা এখানেতো ফুল ছেড়া নিষেধ লেখা আছে। উনি বললেন, ‘এই মেয়ে তোমাকে কি আমি ফুল ছিড়তে বলছি? চারা নিতে বলছি’।
আমার পারিবারিক সমস্যার কারণে আমি ১৯৯৭ সালে চাকরী ছেড়ে দিলাম। তা সত্ত্বেও কিন্তু উনি আমার সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখতেন। তখনতো মোবাইল ছিল না একটা চিরকুট পাঠিয়ে দিতেন, লিখতেন হোমায়রা আমি চট্টগ্রামে আছি। তিনি বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আমাকে সবসময় বলতেন, এত লেখাপড়া করে ঘরে বসে থাকা ঠিক না। তখন আমাকে বিভিন্ন এনজিও থেকে চাকুরীর প্রস্তাব আসতো, কারণ ইতিমধ্যে পরাণ আপার কল্যাণেই বিভিন্ন এনজিওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। তারপর ২০০০ সালে মরহুম এম.এল রহমান (পরাণ আপার স্বামী) এর চেহলাম উপলক্ষে আমাকে দাওয়াত করলেন। সেখানে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বললেন, হোমায়রা আমাকে সবসময় দেখতে আসবে। ওনার এই আন্তরিকতা আমার মনে আজও ভীষণভাবে নাড়া দেয়। এরপর উনি যখনই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসতেন আমাকে বাসায় আসার জন্য ফোন করতেন। আমি গেলে আমার সঙ্গে শিক্ষাবিস্তার নিয়ে আলোচনা করতেন।

আমাকে বলতেন হোমায়রা আমার একটা স্কুল করার খুব ইচ্ছা। মাদারবাড়ীতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছি। উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম চলছে। তিনে শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য এবং সচেতন জাতি ও আত্মবিশ্বাসী জাতি গঠনের লক্ষ্যে একটি আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার ইচ্ছা পোষণ করেন। যেখানে আনন্দচিত্তে শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করবে। তিনি বলতেন, শিশুর বয়স, সামর্থ, অভিরুচীর প্রবণতা অনুযায়ী শিশুদেরকে মেধাসম্পন্ন করে তুলতে হবে। প্রতিটি মানবশিশু সম্ভাবনা নিয়ে এই পৃথিবীতে আসে। তিনি চাইতেন, শিশুরা লেখাপড়ার প্রতি ভীতশ্রদ্ধ বা উদাসীন হয়ে না পড়–ক।
আজ সারা বিশ্বে চলছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে টিকে থাকার প্রতিযোগিতা। এ অগ্রযাত্রায় শিশুদের গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। যেখানে নৈতিকতা শিক্ষা, সংস্কৃতিচর্চা থাকবে এমনি এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন পরাণ আপা দেখেছেন। যদিও তিনি পূর্বে দুইটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ২০০১ সাল থেকে আমাকে নিয়ে স্কুল করার পরিকল্পনা করেন। চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ২০/২৫ টি স্কুল সার্ভে করা হয়। এই সমস্ত স্কুল সার্ভে করে ২০০২ সাল থেকে ঘাসফুল এডুকেয়ার কেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্কুল করতে গিয়ে তিনি ফান্ড সমস্যায় পড়েন, যা তিনি নিজে এবং পরিবারের সদস্য ও অন্যদের কাছ থেকে যোগাড় করেন। পরান আপার অক্লান্ত পরিশ্রমে এই স্কুল আজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্কুলের নামকরণের সময়ও আমার মতামত নিলেন। আমাকে বললেন, আমি স্কুলের অনারারী প্রিন্সিপাল থাকব, তুমি ভাইস-প্রিন্সিপাল হয়ে কাজ করবে। আমি বললাম আপা আমাকে এতবড় দায়িত্ব দিচ্ছেন আমি কি পারব? উনি বললেন অবশ্যই পারবে। আমি তোমাকে দিয়েই এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চাই। অভয় পেয়ে আমি বললাম, আপা দোয়া করবেন যেন আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়। সেই ২০০২ সালে থেকে আমার আবার ঘাসফুলে ফিরে আসা। অনেক সমস্যা, আনন্দ, উচ্ছ্বাস নিয়ে এই স্কুলে যাত্রা শুরু হয়। উনি প্রতিদিন স্কুলে আসতেন এবং বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন মাঝে মাঝে ক্লাসও নিতেন। তাঁর কাছে অনেক কিছু শিখেছি, শেখার যেন শেষ নেই।

উন্নত চট্টগ্রাম নিয়ে যার স্বপ্ন, সেই মানুষটা এখন আর নেই। জন্মের অপর নাম মৃত্যু, আমরাও একদিন চলে যাব। আল্লাহ্ যেন পরাণ আপাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন এবং ওনার অপূরণীয় আশাগুলি যেন পূরণ করতে পারি।
কেমন করে নিজের একটা আলাদা ইতিহাস ও পরিচয় থাকতে পারে সেই পরাণ আপার সান্নিধ্যে এসে জানতে পারলাম। “পরাণ আপা” অনেকগুলো গুণের সমন্বেয়ে গঠিত একটি অরুন্ধুতী, যে অরুন্ধুতী আকাশে কয়েক বছরে একবারই দেখা যায়। “আপা” বিশাল এই পৃথিবীতে আমার উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো মূল কথা নয়, নিজের শিক্ষা, মেধা, অভিজ্ঞতা ও নিজের সঞ্চয় থেকে অসহায় কিছু মানুষের জন্য কিছু করার নামই জীবন।

হোমায়রা কবির চৌধুরী শিমুল অধ্যক্ষ, ঘাসফুল পরাণ রহমান স্কুল

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট