চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

চাই সুচিন্তিত পদক্ষেপ হুমকিতে বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভা-ার

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশি ও এর তলদেশের বিশাল সম্পদ জাতীয় অর্থনীতিতে নানাভাবে অবদান রেখে চলেছে। দেশের উপকূল ঘিরেও রয়েছে নানা সম্পদে সমৃদ্ধির বিশাল হাতছানি। অর্থনীতিকরা বলছেন, পরিকল্পিত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলে বঙ্গোপসাগরের সম্পদরাজি দেশকে সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারও এ ব্যাপারে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এটি একটি আশা জাগানিয়া সুখবর সন্দেহ নেই। তবে গতকাল দৈনিক পূর্বকোণসহ বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভা-ার হুমকিতে পড়ার খবরটি একইসঙ্গে হতাশার। এখনই এ বিষয়ে নজর না দিলে ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগর মৎস্যশূন্য হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিস্থিতি মোটেও হতে পারে না।

বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভা-ার নিয়ে পরিচালিত গবেষণা জরিপে দেখা যাচ্ছে, মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে এবং ইলিশ রক্ষায় সফলতা থাকলেও বঙ্গোপসাগরে মাছের পরিমাণ দিন দিন কমছে। কিছু কিছু সামুদ্রিক মাছের প্রজাতি অনেকটা নিঃশেষ হতে চলেছে বলে সতর্ক করছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, নির্বিচারে সামুদ্রিক মাছ শিকার এবং অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধ উপায়ে মাছ ধরার কারণেই এমনটি হচ্ছে। সম্প্রতি সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা ও জরিপেও এমন মূল্যায়ন করছেন গবেষকরা। সাগরে মৎস্যসম্পদের জরিপ গবেষণা প্রায় দুই দশক বন্ধ থাকার পর ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে কেনা হয় নতুন জাহাজ আরভি মীন সন্ধানী। এরপর শুরু হয় জরিপ কার্যক্রম। সাগরে ১০-২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মহীসোপান এলাকায় এই জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়। গত তিন বছরের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দিনকয়েক আগে একটি প্রতিবেদন সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়। গবেষকদলের প্রদত্ত প্রাথমিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রের সার্বিক মজুদ ঠিক থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু মাছের অতিরিক্ত আহরণ হয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের পরিমাণ নিয়ে গবেষণায় যুক্ত সমুদ্রবিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী, যিনি মৎস্যসম্পদ জরিপ জাহাজ আরভি মীন সন্ধানীর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের সঙ্গেও যুক্ত আছেন, তিনি বলেছেন, এটা খুবই উদ্বেগের। মাছের বংশ বিস্তারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ যেটা রেখে দেয়া দরকার সেটা যদি না রাখা হয় তাহলে পরবর্তী সিজনে বংশবৃদ্ধি হবে না। গবেষক দল বলছেন, আরভি মীন সন্ধানী গবেষণার অংশ হিসেবে গত দুই বছরে ৩২০ বার সাগরে জাল ফেলা হয়। এ সময় ৪০২টি প্রজাতির মাত্র ৬ টন মাছ ধরা পড়ে। যার মধ্যে ৩১১টি প্রজাতির মাছ মাত্র ৫ বার পাওয়া গেছে। ৩১১টি প্রজাতিরই ওজন ছিল আধা কেজির কম। এ সময় দেখা যায় সাগরে আহরণযোগ্য মাছের প্রজাতি রয়েছে সর্বোচ্চ ৫০টি। ৩২০ বার জাল ফেলে মাত্র একটি লাক্ষ্যা মাছ পাওয়া যায়। কোরাল, লাক্ষ্যা, কাইল্লা, বড় সুরমাসহ দামি ও বড় মাছগুলো কম পাওয়া যায়। অথচ ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে সাগরে একই পরিমাণ জাল ফেলা হলে আহরণ করা যেত কমপক্ষে ৬০০ টন মাছ। এ সময় পাওয়া যেত কোরাল, লাক্ষ্যা, সুরমাসহ বড় প্রজাতির মাছ। ওই সময় সাগরে মাছের প্রজাতিও ছিল ৪৭৫টি। এখন গাণিতিক হারে কমছে এসব মাছ।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মালিকানায় রয়েছে বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিশাল এ জলসীমায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি এবং বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ও জৈব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে। দেশের মোট উৎপাদিত মাছের ১৬ শতাংশ আসছে বঙ্গোপসাগর থেকে। কিন্তু সমুদ্রপরিবেশ দূষণ, মাছশিকারে ‘পেডিকোট’ জালের ব্যবহার, অবৈধভাবে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রতিবেশী দেশগুলোর নৌযানের অনুপ্রবেশ এবং অবৈধভাবে মৎস্য শিকার করে নিয়ে যাওয়া ও মৎস্য আহরণে স্বেচ্ছাচারিতার কারণে দিনদিন মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অনেক মাছ বাণিজ্যিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রবল ঝুঁকিতে আছে। গবেষক দল এভাবে চলতে থাকলে এক সময় থাইল্যান্ডের ‘গালফ অব থাইল্যান্ড’-এর পরিণতি বরণ করে বঙ্গোপসাগরও মৎস্যশূন্য হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আমরা মনে করি, দেরী না করে বিষয়টি আমলে নিয়ে বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভা-ারকে হুমকিমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ ব্যাপারে সময় ক্ষেপণের সুযোগ নেই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট