চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

ইরানের বিপ্লব দিবস

কালান্তরে দৃষ্টিপাত

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

ইমাম খোমেইনী ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে বিজয় ঘোষণা করে। পাহলভী রাজতন্ত্রের শাসন অবসান হয়ে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব হয়। ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ইরান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৬ লাখ ৪৮ হাজার বর্গ কি মি দেশ ইরান। বাংলাদেশের প্রায় ১১ গুণ বড়। জনসংখ্যা প্রায় ৭ কোটি।

সীমান্তের দিকে স্বল্প সংখ্যক সুন্নিবাদে সবাই শিয়া। কাজেই ইরান শিয়া অধ্যুষিত দেশ। নবী পাক (স.)’র ওফাতের পর আমরা খেলাফতে বিশ^াসী। আমাদের মহান চার খলিফা যথা-১। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (র.) ২। হযরত ওমর ফারুক (র.) ৩। হযরত ওসমান গণি (র.), ৪। হযরত আলী (ক.) আমরা। এ চারজনকে আমিরুল মোমেনীন হিসেবে মূল্যায়ন করি।
শিয়া মতাদর্শ তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত। শিয়াদের মধ্যে ভাগ উপভাগ রয়েছে। যেমন ইসমাঈলী শিয়া, আগাখানী শিয়া, বোখরা শিয়া, জায়েদী শিয়া ইত্যাদি। তাদের মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিতে শিয়ারা এক। শিয়াদের সাথে আমাদের বড় বড় পার্থক্য রয়েছে। তাঁর মধ্যে অন্যতম প্রধান পার্থক্য হল তারা আমাদের প্রধান চার খলিফাকে গ্রহণ করে না।
তারা ইমামিয়তে বিশ^াসী। এতে তাদের বার ইমাম। ১ম ইমাম হযরত আলী (ক.)। আহলে বায়েত তথা পর পর ১২ জন আওলাদে রসুল তাদের ১২ ইমাম। যথাঃ- প্রথম ইমাম হযরত আলী (ক.) যিনি ইরাকের নজফে শায়িত; দ্বিতীয় ইমাম হযরত ইমাম হাসান (র.) যিনি মদিনা মুনাওয়ারার জান্নাতুল বাকীতে শায়িত; তৃতীয় ইমাম হযরত ইমাম হোসেন (র.) যার শরীর মোবারক কারবালায় এবং মস্তক মোবারক কায়রো নগরীতে শায়িত; চতুর্থ হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (র.); পঞ্চম ইমাম হযরত বাকের (র.); ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর ছাদেক (র.); জান্নাতুল বাকী হযরত ইমাম হাসার (র.)’র পর পর শায়িত; সপ্তম ইমাম হযরত মুসা কাজিম (র.), যিনি ইরাকের রাজধানী বাগদাদে শায়িত; অষ্টম ইমাম হযরত আলী রেজা (র.) যিনি ইরানের মাশাদ শহরে শায়িত; নবম ইমাম হযরত মুহাম্মদ জাওয়াদ তকী (র.), যিনি বাগদাদে ইমাম মুসা কাজিম (র.)’র পাশে শায়িত; দশম ইমাম হযরত আলী আননকী (র.) ও এগারতম ইমাম হযরত আল হাসান আল আশকারী (র.) যিনি ইরাকের রাজধানী বাগদাদের ১৫০ কি.মি উত্তরে শামরায় একই এরিয়ায় শায়িত; বারতম ইমাম হযরত মেহেদী (আ.) জন্ম হলেও প্রকাশ উহ্য রয়েছে।

ইসলামী বিপ্লবের পর তাদের শাসনতন্ত্র ব্যতিক্রম। শাসনতন্ত্র মতে ইমাম খোমেনী ইরানের ইমাম। সর্বোচ্চ মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী। শাসনতন্ত্র মতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবে। দেশ পরিচালনা বিদেশের সাথে দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। কিন্তু মর্যাদা ক্ষমতা ইমামের পরে। ইরানের রয়েছে ইসলামী গার্ড। যদিওবা দেশে পূর্ণাঙ্গ তিন বাহিনী রয়েছে। যথা-সামরিক বাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ-বাহিনী। তারপরেও ইসলামী গার্ডের আলাদা সম্মান, মর্যাদা, ক্ষমতা।
ইমাম খোমেনীকে অঘোষিতভাবে ১৩ নম্বর ইমাম হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকে। তাঁর সৌভাগ্য হল তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেন নি। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধাও না। নিজের ঘরে সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। এতেই বিদেশ থেকে রাজা বাদশাহ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, ইরান সফরে আসলে ইমাম খোমেনীর সাথে সাক্ষাত করা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু তার আবাসস্থলে যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় ইরানের প্রশাসনিক সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ত। একবার তাঁর ঘরটি সাজিয়ে দিতে সরকারের লোকজন গিয়েছিল।

তিনি জানতে পেরে তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। এ সাধারণ জীবনযাপনকারী ইমাম খোমেনী ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তেহরান শহরের উপকণ্ঠে ইসলামী বিপ্লবের জন্য শহীদগণের কবরস্থানের নিকটে তাকে সমাহিত করা হয়। তাঁর মাজার কমপ্লেক্স শত হাজার কোটি টাকার ব্যয় সাপেক্ষ। তিনি ইন্তেকালের পর তাঁর স্থলে বর্তমান ইমাম হোসেন আলী খামেনী। রাজতন্ত্রীয় শাহর আমলে ইরানীরা পশ্চিমা স্টাইলের বিলাসী জীবন যাপনে ছিল। কিন্তু ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান শতভাগ পাল্টে যায়। অতি বিলাসী জীবন বিদায় নেয় বলা যাবে।
মহিলারা পুরুষের সমান্তরালে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতেছে। প্রায় সব ক্ষেত্রে কর্মতৎপর। তাদের শালীনতা পর্দা রক্ষা করা মুসলিম বিশে^ শিক্ষনীয় অনুকরণীয়। বিশাল দেশ মানুষ ৭ কোটি। যা তাদের জন্য যথাযথ। টাকা রোজগারের জন্য বিদেশেও যেতে হয় না, দেশে কাজ করার জন্য লোকও আনতে হয় না। তাদের দেশে খাদ্দামা প্রাথ নাই বললেই চলে। ঘরের কাজ নিজেরাই করে। নারীরা যেমনি কর্মক্ষেত্রে তৎপর তেমনি স্বচ্ছল। পরিবারে রয়েছে তাদের নিজস্ব গাড়ী। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ^ ইরানকে কাবু করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতেছে। এতে তারা কতটুকু কৃতকার্য হচ্ছে ভাবতে হবে। ইরানের জনগণ সৎ, শিক্ষিত, দেশপ্রেমিক, কর্মঠ বিধায় দেশ দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। ইরান অনেকটা স্বয়ং সম্পূর্ণ বলা যাবে। তাদের উৎপাদিত জিনিস তারাই ব্যবহার করে। যেমন – কার, জীপ, বাস, ট্রাক, রেল, রেলের ইঞ্জিন, জাহাজ, যুদ্ধ জাহাজ,ছোট ছোট বিমান, যুদ্ধ বিমান ইত্যাদি ইতাদি। এসব কিছুর মধ্যে অনেক কিছু বিদেশেও রপ্তানী করে থাকে। অর্থাৎ বড় বড় বিমান বাদে ইরান নিজের পায়ে দাড়ানো বলা যাবে। বিভিন্ন প্রকারের বাদাম, কিসমিস, খেজুরসহ নানা কিছু ব্যাপক উৎপাদিত হয়। আমাদের দেশে আমদানিও হয়। ইরানের জাফরান বিশ^বিখ্যাত। তাদের খাবার স্বাস্থ্য সম্মত। উজবেকিস্তান, ইরান, তুরস্ক এ সব দেশে অতি মসলা মিশ্রিত খাবার খায় না। সালাদ বেশি খায়। খাবারের সময় দুধ চিনি বিহীন চা খেয়ে থাকে বেশি। ইরানে গরমকালে অতি গরম, শীতকালে কোন কোন জায়গায় বরফ পড়ে। ইরানে ট্রেন যাতায়াত ব্যবস্থাপনা উন্নত আন্তর্জাতিক বিশে^র কাছাকাছি পর্যায়ে। তবে অভ্যন্তরীণ ও আকাশ যাতায়াত রয়েছে প্রতিকূলতা। যেহেতু উন্নত বিশে^র মত বড় বড় বিমান তৈরী করতে অক্ষম। অবশ্য উন্নত বিশে^ কয়েক দেশের সমন্বয়ে সহযোগিতায় বড় বড় যাত্রীবাহী বিমানগুলো নির্মাণ করে থাকে।

আনবিক বোমা গোপনে থাক বা না থাক ইরান যে হারে এগিয়ে গেছে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বুঝের অভাব হলেও ইউরোপীয়রা তেহরানের সাথে সহাবস্থানে থাকাটা কল্যাণকর মনে করতেছে। সে লক্ষ্যে ইরানের সাথে চুক্তিও করেছে। যেহেতু ইরান প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে রাখছে তাদের দেশ আক্রান্ত হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইসরাইলকে মানচিত্র হতে মুছে দেয়া হবে। এতে বিশ^ বুঝতে পারতেছে ইরান শক্তির দিক দিয়া অনেক এগিয়ে রয়েছে। আগেই উল্লেখ করেছি শিয়াদের মতাদর্শে আমাদের সুন্নিদের সাথে রয়েছে বড় বড় ব্যবধান। তারপরও তাদের দুইটি জিনিস আমাকে অভিভূত করে, যথা Ñ
১। কুখ্যাত লেখক সালমান রুশদীকে মুসলিম বিশে^র কোন নেতা ইমাম খোমেইনীর মত শক্ত অবস্থানে যায় নি। রুশদী নবী পাক (স’)র শানে বেয়াদবী করায় তার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে। ইমাম খোমেইনী মৃত্যুবরণ করে গেছেন। কিন্তু ঘোষণা রয়ে গেছে। অতএব, রুশদীর পক্ষে আমৃত্যু প্রকাশ্যে চলাফেরা অসম্ভব।
২। পর পর ৩ বার ইরান সফরের সুযোগ হয়েছিল। বিশাল ইরানের বড় বড় শহরে যাওয়া হয়। বড় বড় অনুষ্ঠানে যোগদান করার সুযোগ হয়। এসব অনুষ্ঠানাদিতে আলোচনা বা যে কেউ নবী পাক (স)’র নাম উচ্চারণ করলে অনুষ্ঠানের সকলে বড় শব্দে দরূদ শরীফ পড়বে। আধা বা এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময়ের অনুষ্ঠানে নবী পাক (স.)’র নাম যত বারই উচ্চারিত হউক না কেন ততবারই উপস্থিত সকলে সমস্বরে দরূদ শরীফ পড়বে। আর তা হল, ‘আল্লাহুমা সল্লি আলা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলি মুহাম্মদ।’

শিয়ারা বিশে^ ১০/১২ কোটি বা তার কম বেশি হবে। তাদের দায়িত্ব হবে সোয়া শত কোটি সুন্নিদের সাথে সহাবস্থানে থাকা। এতে বিশে^ মুসলমানগণের ঐক্য আরও সুদৃঢ় হবে। ঢাকায় রয়েছে ইরানের দূতাবাস। রাষ্ট্রদূতরা আসেন বদলি হয়ে চলে যান। রাষ্ট্রদূত চলে যাওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগদান করেন গড়যধসসধফ জবুধ ঘধভধৎ। আগেকার রাষ্ট্রদূতের মত মাননীয় রাষ্ট্রদূত গড়যধসসধফ জবুধ ঘধভধৎ সাথে সৌজন্য সাক্ষাত হয়। তাঁকেও বলি মুসলমানগণের মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন। তিনিও আমার সাথে একমত পোষণ করেন। পরিশেষে বিপ্লব বার্ষিকীতে ইরানের কল্যাণ কামনা করছি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট