চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টলার দিলীপ কানুনগোর সাথে অভূতপূর্ব একটি বিকেল

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ডা. দিলীপ দে

২৭ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:৩৮ পূর্বাহ্ণ

আবদুল জব্বার কাদ্দার এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে বললেন,‘কানুনগো’র রক্ত চাই।’ হাবিবুল্লাহ বাহার তখন ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। তিনি অস্থির সব মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,‘নীরেন্দ্র কেন গুর্খা এনেছে তার বিচার হবে। আপনারা শান্ত হোন।” এভাবে নীরেন্দ্রনাথের বন্ধুত্বের দাম দেন হাবিবুল্লাহ বাহার। প্রসঙ্গতঃ, হাবিবুল্লাহ বাহার বিদ্রোহী কবি নজরুলের প্রিয় পাত্র ছিলেন। নোয়াখালী রায়টে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে নীরেন্দ্রনাথের ভূমিকা তৎকালের অনেক উচ্চবর্গীয় নেতৃবৃন্দ কর্তৃক প্রভূত প্রশংসিত হয়েছিল। (যেমন সুচেতা কৃপালিনী, গান্ধীজির একান্ত সচিব প্রমুখ এ কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন।)
’৪৭ এর দেশ ভাগের প্রাক্কালে নীরেন্দ্রনাথ কানুনগো নোয়াখালী থেকে ‘অপসন’ দিয়ে তথা ইচ্ছে অনুযায়ী বেছে নিয়ে স্টেট সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং একজন সিনিয়র সদস্য হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে পুনর্বাসন বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন বর্ধমান জেলার। সে সময় তাঁর বর্ধমানের বাড়িতে ৫০-৬০ জন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অভিবাসী। ৩০০ ভরি অলংকার ছিল মাধুরীর। এক খন্ড জমি ও বাড়ি করেন নি।
কোলকাতায় এসে আমরা একসময় থিয়েটার রোডে থাকতাম সাত ভাই দুই বোন। ভাই প্রদীপ কানুনগো নয় বছরের ছোট। তিনি ক্যান্সার স্পেশালিস্ট।”
দিলীপ কানুনগো বর্ধমান থেকে ¯œাতক। কোলকাতায় তাঁর জীবনের পরিধি ছিল ব্যাপক। কতো মানুষের সাথে যে তাঁর পরিচয় আনাগোনা তা বলে শেষ করা যাবে না। শিয়ালদা ও হাওড়া’র রিফিউজি সংগঠনগুলোতে কাজ করতেন প্রচুর। ক্রমশ অজ¯্র সাংস্কৃতিক সংগঠনে যুক্ত হন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে রাত সাড়ে দশটার আগে ঘরে ফিরলে মা বলতেন-“তোর শরীর ঠিক আছে তো ?”
একবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ভারতবাসীকে একবেলা খেতে অনুরোধ করেছিলেন। দিলীপ কানুনগো তখন দুই বছর একবেলা খেয়েছিলেন। অসাধারণ মানুষগুলোর নীতি ও আদর্শবোধ। দেশপ্রেম ও তার আঙ্গিকে যাপিত জীবনবোধ হয় এমনই শিক্ষণীয় হয়।
১৯৭২ সালে ১৮ এপ্রিল এর ‘জালালাবাদ দিবস’কে উপলক্ষ্য করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কোলকাতা থেকে যে প্রতিনিধি দল আসে, তার মধ্যে তিনিও ছিলেন। মাস্টারদা ও তাঁর সূর্যসাথী বিপ্লবীদের পুণ্য পদস্পর্শ সিক্ত এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এ’ বিপ্লবীদের সম্মুখ সমররত যুদ্ধস্থল ঐতিহাসিক ‘জালালবাদ যুদ্ধ’ খ্যাত চট্টগ্রাম জালালাবাদ পাহাড়ে যে প্রতিনিধিরা শ্রদ্ধা জানাতে যান। তার মধ্যে তিনিও ছিলেন। ২৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধ’ুর সঙ্গে দেখা করে তাঁরা মাস্টারদা সূর্য সেনের প্রতিকৃতি উপহার দেন। সূর্যসেনের প্রতিকৃতিসহ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সেই ছবি দেখলাম ঘরের দেয়ালে দৃশ্যমান। লক্ষণীয়, বাংলাদেশের অসংখ্য স্মৃতিতে এ ঘরের দেয়াল, আলো-বাতাস, পরিবেশে ভরপুর। এ’ যেন এক বাংলাদেশ কিংবা চট্টগ্রাম। অথবা এ’ যেন বোয়ালখালীর সেই নিভৃত গ্রাম কানুনগোপাড়া। যেন কোলকাতায় এক বৃহৎ চট্টল ভূখ-। আর তার মাঝেখানে বসে আছেন গৃহকর্তা চট্টগ্রামের দিলীপ কানুনগো।
এরই মাঝে একটা ক্ষুদ্র গ্রন্থ বের করে তিনি আমাকে বলেন, “এটাকে লক্ষ টাকার দামী মনে করি। আমার মা ছিলেন প্রীতিলতা কল্পনা দত্ত এদের সবার কাছে বড়দি। আমার মা’র বিয়েতে এই বইটি রাণী তথা প্রীতিলতা আমার মাকে দিয়েছিলেন উপহার স্বরূপ।’ অবিভক্ত ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম মহিলা শহীদ প্রীতিলতা ওয়েদ্দাদার এই বইটি তাঁর মাকে দেন।
শ্রদ্ধাভরে খুলে দেখলাম- প্রীতিলতা তাতে লিখেছেন, “অতি আদরের ¯েœহময়ী কুন্তু দিদিকে শুভ পরিণয়োপলক্ষে এই ক্ষুদ্র পুস্তকখানি ‘স্মৃতি বিতান’ স্বরূপ উপহার দিলাম। -ইতি ¯েœহের রাণী। চট্টগ্রাম, ২৫ আশ্বিন ১৩৩৪ বাংলা।” শুভবিবাহ- শ্রী যোগেন্দ্র গুপ্ত প্রণীত,প্রকাশক- শ্রী আশুতোষ ধর, আশুতোষ লাইব্রেরী, ৩৯/১ কলেজ স্ট্রীট কলিকাতা। ১৩৩২, মূল্য-একটাকা।
“বইটি সম্পর্কে একটি মজার ঘটনা। ১৯৭২ সালে কোলকাতা টিমের সাথে বাংলাদেশ সফরে এসেছি। মুজিবের সঙ্গে বসেছি। প্রেসক্লাবে সম্বর্ধনা দিয়েছে। গ্রামে গিয়ে এই বইটি নিয়ে আসি। বঙ্গবন্ধু এই বইটি দেখে বলেন- ‘এই বইটি তো নিতে দেবো না! আমি সুভাষ বোসের কথা বলেছি, প্রীতিলতার কথা বলেছি বাংলাদেশে থেকে।’ আমি বল্লাম, ‘বঙ্গবন্ধু, এই বই লক্ষ টাকার বিনিময়েও দেবো না। এটা আমার মা’র কাছে প্রীতিলতা’র উপহার দেওয়া বই।’ তখন মুজিব আমাকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, ‘এইতো চেয়েছিলাম চট্টগ্রামের মানুষের কাছে’।” পুলিন দে ছিলেন কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি বল্লেন, পুলিন দে ছিলেন ১৯৭৫ এর ভিজিট এর সময়।
নেলী সেনগুপ্তাকে যখন ইন্দিরা গান্ধী ভারতে নিয়ে এলেন তখন যে কয়েকজন লোক তাঁর সঙ্গে যখন-তখন দেখা করতে পারতেন তার মধ্যে দিলীপ কানুনগো একজন। নেলী সেনগুপ্তা মারা যাবার পর যে কমিটি হয় দিলীপ কানুনগো ছিলেন তার মুখ্য সংযোগ সচিব। জে.সি.দে পদ্মভূষণ ছিলেন তার সভাপতি। নেলী সেনগুপ্তার স্মৃতি রক্ষা কমিটি থেকে তাঁরা ‘ ঙঁৎ ঐড়সধমব’ নামক স্মারক গ্রন্থ বের করেন। প্রফেসর ড. মো. ইউনুস নোবেল পুরস্কার পেলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। সেই ছবিও রয়েছে দেয়ালে। ড. ইউনুসের স্ত্রী আফরোজী ইউনুস তাঁর ছোটবোনের বন্ধু।
সুচন্দা, জহির রায়হান, এম. এ. হান্নান, কর্ণেল ওসমানী – তাঁর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। নীলিমা ইব্রাহীম, সুবিমল দত্তের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা ছিল। কবি শামসুর রাহমান, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ- শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ এবং কিংবদন্তী রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশারদ, এঁদের সঙ্গে তাঁর ছিল আন্তরিক যোগাযোগ। নেলী সেনগুপ্তার ১৯৬৯ সালের ছবি, লেডি রাণু মুখার্জী (স্যার বীরেন-এর স্ত্রী)ও অন্যান্য বিখ্যাত লোকদের ছবি দেখলাম তাঁর সাথে, যাঁদের অনেকের নাম আমি জানি না। উষা উপ এর সঙ্গে ছবি। কল্পনা যোশী, সেন্ট লরেন্স এর শিক্ষক ডি এ ব্রু- এদের সঙ্গে সহ অজ¯্র খ্যাত-বিখ্যাত মানুষের সাথে ছবি।কোলকাতা গভর্নর হাউসেও দেখলাম রয়েছে তাঁর যথেষ্ট যাতায়াত। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় সংহতি সংসদ ১৯৯৭ সালে তাঁকে সংবর্ধনা দেন। কোলকাতায় চট্টগ্রাম পরিষদের তিনি এককালের সহ-সভাপতি। দেয়ালে দেখলাম, তাঁর মা ও বাবার ছবি শোভা পাচ্ছে। কথায় কথায় বল্লেন,‘আমার বাবা বর্ধমান জেলায় গার্লস হাই স্কুল করেছেন।এছাড়াও মেদিনীপুর স্কুল করেন’।
চট্টগ্রামের ড.সুনীতি ভূষণ কানুনগো, তাঁর রচিত “ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রাম” (প্রকাশকাল -২০০৫) নামক সারগর্ভ গ্রন্থটি শ্রী দিলীপ কানুনগোকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে তিনি লিখছেন- ‘আমার জ্যেষ্ঠ পিতৃব্য পুত্র সর্বজনপ্রিয় সদাপ্রফুল্ল পরহিতব্রতী সুকবি চিরকুমার নিবেদিতপ্রাণ আমাদের বংশের গৌরব শ্রীমান দিলীপ কুমার কানুনগোকে অর্পণ করলাম ”- গ্রন্থকার।
বোধ করি দিলীপ কানুনগো’র সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমার আরো একটি সম্পদ প্রাপ্তি ঘটেছিল। তা হলো প্রীতিলতাকে নিয়ে কি যে নীরব বিপ্লব, একজন অসামান্য অথচ সাধারণ ব্যক্তি, পশ্চিম বাংলায় করে চলেছেন তাঁর পরিচয় ও ইতিহাস লাভ। খুলনা থেকে পশ্চিম বাংলায় চলে আসা স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রী হরিপদ দে খাঁটুরা গোবরডাঙ্গায় চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের ঠিক ত্রিশ বছর পরে ১৯৬০ সালে ১৮ এপ্রিলে “প্রীতিলতা শিশু নিকেতন” প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে যে যাত্রা শুরু করেন তা এখনো চলমান। এখানে ক্রমশঃ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যথাক্রমে প্রীতিলতা বালক শিক্ষা নিকেতন ও বালিকা শিক্ষা নিকেতন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রীতিলতা একাডেমী। হরিপদ দে’র স্বপ্ন -এখানে একদিন প্রীতিলতা বিশ্ববিদ্যালয় হবে। দিলীপ কানুনগোকে তিনি চেয়েছিলেন এই স্কুলে একটি অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি করে নিয়ে যেতে কিন্তু অসুস্থ থাকার কারণে তিনি যেতে পারেন নি।
তবে প্রতিষ্ঠানটির একটি নাতিদীর্ঘ ইতিহাস আমার ‘কোলকাতার ডাইরী’তে লেখা আছে তাঁরই দাক্ষিণ্যে। শ্রী হরিপদ দে তাঁর “খাঁটুরা প্রীতিলতা শিক্ষা নিকেতন উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ” নামক এক প্রকাশনায় যাঁদের উপদেশ পরামর্শ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন তার মধ্যে দিলীপ কানুনগোর নাম সর্বাগ্রে। চটগ্রামের শ্রী দিলীপ কানুনগো এ প্রকাশনার অনবদ্য মূখবন্ধ’টি লিখেছেন, যা নি¤œরূপ-“গোবরডাঙ্গা পৌরসভার খাঁটুরায় ‘প্রীতিলতা শিশু শিক্ষা নিকেতন’এর শুভ সূচনার মাধ্যমেই আমরা স্বাধীন ভারতে আদর্শ শিক্ষিকা তথা অকুতোভয় বিপ্লবী প্রীতিলতার অবিনাশী স্মৃতিরক্ষার সর্বপ্রথম প্রয়াস দেখলাম।” গোবরডাঙ্গায় প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের এই প্রীতিলতা তীর্থে আগামীতে কখনো গিয়ে দিন কয়েক থেকে আসার ইচ্ছে আছে।
কথায় কথায় তন্ময়তায় খেয়ালই হয় নি বেলা কখন গড়িয়েছে। গৃহকর্তা বার বার আমাকে খাবার জন্য বলছেন। কখনো মাছ ভাজি, কখনো নিরামিষ তরকারী। আমিও কেবল ‘না’ ‘না’ বলে যাচ্ছি। এবার যাবার পালা। আসার সময় ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো’র জন্য দিলেন একটা বই এবং একটি চিঠির প্রত্যুত্তর। আমি তাঁর একটা ছবি তুললাম। বাইরে বেরিয়ে আসছি,অত্যন্ত বিনয় সহকারে তিনি আমার হাতে দিলেন এক প্যাকেট বিস্কিট। এ আন্তরিকতার গভীরতা অমূল্য মনে হলো। পকেটে নিলাম প্যাকেটটি। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে তীব্র রোদ দেখে ৭৪ বছরের এই ‘বৃদ্ধ যুবক’ ভেতরে গিয়ে ছাতা নিয়ে এলেন। রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। আমার কোন বাধা শুনলেন না। তারপরে একটা রিক্সা ডেকে তাকে পৌঁছে দিতে বললেন আমার পরবর্তী গন্তব্যে, বর্তমানে যাদবপুর নিবাসী- চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া’র ডা. মিহির দাশের চেম্বারে। আর, বলে দিলেন আমার কাছ থেকে যেন ভাড়া না নেয় এবং আমাকে পৌঁছে দিয়ে পর বাসায় গিয়ে তাঁর কাছ থেকে যেন ভাড়াটা নেয়া হয়।
তাঁকে বিদায় জানিয়ে চারিদিকে রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশের নীচ দিয়ে প্রশস্ত সড়ক বেয়ে রিকসায় যেতে যেতে মনে হলো, দিলীপ কানুনগো আপন জন্মভূমি থেকে এখানে এসে নিজের চারপাশে একটা আপন জগৎ একটা আপন ভুবন সৃষ্টি করেছেন, যার কেন্দ্রে রয়েছে তাঁর আপন জন্মভূমি- নমস্য চট্টগ্রাম। আর, দিলীপ কানুনগো, স্বদেশের প্রতি ভালবাসাকে পাথেয় করে যেন তার চারপাশে আবর্তিত। রিক্সাওয়ালা থামলো। শত বলা সত্ত্বেও আর ভাড়া নিল না। নেমে এসে দেখলাম, চেম্বারে আছেন ডা. মিহির। সমাপ্ত

লেখক : শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক, গবেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট