চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর সেনানী শহীদ ক্যাপ্টেন কাদের বীর উত্তম

মো.নিজাম উদ্দিন লাভলু

২৭ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:৪০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের দেয়া ঐতিহাসিক স্বাধীনতার বজ্র ঘোষণার ঢেউয়ে সীমান্তবর্তী পার্বত্য মহকুমা রামগড় যখন উত্তাল-উত্তপ্ত, পাক সরকারের বিরুদ্ধে গঠিত আওয়ামী সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে যখন সরকারবিরোধী তীব্র বিক্ষোভ আন্দোলন চলছিল। এমনি এক মুহূর্তে টগবগে সুদর্শন এক যুবকের আগমন ঘটে এ সীমান্ত শহরে। চোখে-মুখে তার কঠোর প্রতিশোধের স্পষ্ট ছাপ। শহরের উপকন্ঠে জনৈক বিএম খানের চায়ের দোকানে বসে একের পর এক ক্যাপেস্টেন সিগারেট ফুঁকাচ্ছেন আর চা পান করছেন । পর্বতসম এক ভাবনায় যেন বিভোর। এ আগন্তুক যুবককে নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা দেখা দেয় এলাকায়। কে এ যুবক? কী তার পরিচয়? এ টালমাতাল অবস্থায় এখানে তার আসার হেতু কী ইত্যাদি প্রশ্নের উদ্রেক হয় সবার মনে।
হঠাৎ একদিন সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে, এ টগবগে যুবক আর কেউ-ই নন, তিনি বাংলার গর্বিত সন্তান ক্যাপ্টেন আফতাব আল কাদের (ইকবাল)। নিজের পরিচয় প্রকাশ করেই স্থানীয় বাঙালি ইপিআর সদস্য এবং মুক্তিকামী স্থানীয় যুবকদের নিয়ে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ কাজে লেগে পড়েন তিনি। যে করেই হোক রামগড়কে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত রাখতে হবে, এখানে গড়ে তুলতে হবে শত্রুদের মোকাবেলা করার এক শক্তিশালী ঘাঁটি হিসাবে। পাক হানাদারদের উপর ইস্পাত কঠিন আঘাত হানতে হবে তাদের নাস্তানাবুত করে এ দেশকে শত্রুমুক্ত স্বাধীন করতে হবে- এই ই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
২৫শে মার্চের কালোরাতে পাকবাহিনীর নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালি নিধনযজ্ঞের বর্বরতা বাঙালি তরুণ কাদের এর মনে তীব্র প্রতিশোধের জন্ম দেয়। প্রতিশোধের জ্বালা নিয়ে ৪০ ফিল্ড আর্টলারি রেজিমেন্টের অকুতোভয় সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন আফতাব আল কাদের ২৭শে মার্চ সকালে বেরিয়ে পড়েন ঢাকার ফরিদাবাদের ২১ লালমোহন পোদ্দার লেনের বাসা থেকে। প্রিয় মা, বাবা, ভাই, নববধূ, বন্ধু-বান্ধব সবার বন্ধন যেন ম্লান হয়ে যায় প্রতিশোধ আর দেশমুক্তির নেশায়। পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের হায়দ্রাবাদে ছিল তাঁর কর্মস্থল। ৫ই ফেব্রুয়ারি ’৭১-এ ঢাকায় বাড়ি এসেছিলেন ছুটিতে। ১৯ই ফেব্রুয়ারি কাউকে না জানিয়েই তিনি কোর্টম্যারেজ করেন ‘জুলিয়া’ কে। দেশমাতৃকার প্রেমে ব্যাকুল তেজো-দীপ্ত বাংলার বীর সেনানী ক্যাপ্টেন কাদের এর নেতৃত্বে রামগড় হাই স্কুল মাঠে বিরামহীনভাবে চলতে থাকে যুব প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। রামগড়ের একমাত্র সেনা অফিসার কাদের স্থানীয় ইপিআরের সুবেদার মফিজুল বারী, হাবিলদার আবুল কাশেমসহ কয়েকজন ইনস্ট্রাক্টর এবং স্বল্পসংখ্যক অস্ত্র নিয়ে পরিচালনা করেন গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ।
২রা এপ্রিল রামগড় আসার পর ক্যাপ্টেন কাদের সর্বপ্রথম অপারেশন পরিচালনা করেন ফেনীর শুভপুর এলাকায়। রণ কৌশলের আবশ্যকীয়তায় ক্যাপ্টেন কাদের পরিকল্পনা নিয়ে ইপিআরের হাবিলদার কাশেমের প্লাটুনসহ মীরসরাইয়ের জোরালগঞ্জে স্থাপন করেন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। এখানে ধুমঘাট রেলওয়ে ব্রীজ ধ্বংস করার পরিকল্পনা অনুযায়ী একের পর চেষ্টা চালানো হয় তাঁর নেতৃত্বে। তিনদিন চেষ্টার পর ৫ই এপ্রিল ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার এ অপারেশন সফল হয়। ১০ই এপ্রিল মেজর জিয়ার নেতৃত্বে ৫০ সদস্যের একটি গ্রুপের সাথে ক্যাপ্টেন কাদের রামগড় সেক্টর হেডকোয়ার্টার ত্যাগ করে খাগড়াছড়ি চলে যান। ক্যাপ্টেন কাদের ও ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান মেজর জিয়াকে সঙ্গে নিয়ে খাগড়াছড়ি থেকে চলে যান মহালছড়িতে। এখানে অবস্থানরত মেজর শওকতকে রামগড়ে পশ্চাদাপসরণের নির্দেশ দিয়ে মেজর জিয়া ফিরে আসেন রামগড়ে।
মেজর শওকতের নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন কাদের তাঁর গ্রুপ নিয়ে চলে যান রাঙামাটিতে।
রাঙামাটি শহরে পাকবাহিনীর বড় সমাবেশের খবর পেয়ে তিনি তাঁর গ্রুপ নিয়ে বন্দুকভাঙ্গা নামক এক দ্বীপের মত স্থানে অবস্থান নেন। এখানে ২১শে এপ্রিল দুই লঞ্চ বোঝাই পাকসেনাদল হঠাৎ আক্রমণ চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছাত্র শওকত ও অন্যান্য সদস্যরা শত্রুদের উপর বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ করে। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী চলা এ প্রচ-যুদ্ধে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকজন হতাহত হওয়ার পর তারা পিছু হটে যায়। বন্দুকভাঙ্গায় দুই দিন অবস্থানের পর মেজর শওকতের নির্দেশ পেয়ে ২৪ এপ্রিল তিনি গ্রুপ নিয়ে রওনা হন মহালছড়ির উদ্দেশ্যে। মহালছড়ি যাওয়ার পথে বুড়িঘাট এলাকায় শত্রুপক্ষের অতর্কিত আক্রমনের শিকার হন তাঁরা। আকস্মিক এ হামলায় তাঁর গ্রুপের সদস্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন কাদের ও তাঁর দুই সহযোদ্ধা হাবিলদার সায়ীদ এবং হাবিলদার তাহের তিনজন তিনটি এলএমজি নিয়ে প্রবল আক্রমণ চালায় পাকবাহিনীর উপর। এখানেও শত্রুরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে যায়।
এভাবে একের পর এক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচ- হামলার মুখে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পাকবাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। তারা মিজোরামের দু’টি বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্যদের নিজদলে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে। এছাড়া ভারতের নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের একটি অংশকে নিয়ে গোপনে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন-নতুন গ্রুপ গঠন করে। অন্যদিকে স্থল আক্রমণের সাথে সাথে বিমান ও হেলিকপ্টারের সাহায্যেও শুরু করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য অবস্থান ঘাঁটির উপর প্রবল হামলা। চলবে
ি তথ্যসূত্র : শহীদ ক্যাপ্টেন কাদেরের পরিবার।

লেখক : দৈনিক পূর্বকোণ প্রতিনিধি, রামগড়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট