চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দুর্ঘটনা, নাকি নাশকতা আবারো বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-

৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ২:০২ পূর্বাহ্ণ

সপ্তাহের ব্যবধানে মির্জাপুল এলাকার ডেকোরেশন গলির দুটি পাশাপাশি কলোনিতে আবারো আগুনে পুড়েছে শতাধিক বসতঘর। শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টায় স্থানীয় হুমায়ুন কলোনি ও শফিক কলোনিতে এ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। তবে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সকাল সোয়া ১০টায় আগুন লাগলেও কিভাবে লেগেছে কেউ বুঝতে পারেনি। ২৪ জানুয়ারিও একই সময়ে ওই এলাকার খোকন কলোনি, বাবু কলোনি, হোসেন কলোনি ও শওকত নেওয়াজ কলোনিতে আরেক অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে কেউ হতাহত না হলেও প্রায় দুই শত বসতঘর ভস্মিভূত হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের লোকজনের ধারণা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে সেখানে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। সে অগ্নিকা-ের ঘটনা তদন্তে জেলাপ্রশাসন থেকে একটি তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ঠিক কি কারণে সেদিন আগুন লেগেছে তা তদন্তে শণাক্ত হবে নিশ্চয়ই। তবে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে একই এলাকায় ফের অগ্নিকা-ের ঘটনাটি ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এটি কি সত্যিই দুর্ঘটনা, নাকি নাশকতা, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অনেকের দাবি এটি দুর্ঘটনা নয়, ইচ্ছে করে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এ সন্দেহের বিষয়টি নাকি পুলিশও উড়িয়ে দিচ্ছেন না। আবার আগুন লাগার পরে জায়গার মালিকের বাসায় হামলার ঘটনাও ঘটে। জায়গা-জমি নিয়ে সেখানে মামলা-মোকাদ্দমাও রয়েছে। সবমিলিয়ে অনেকের ধারণা এটি কোন দুর্ঘটনা নয়, নাশকতা। সংগতকারণে অগ্নিকা-ের ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। নাশকতা প্রমাণিত হলে, এর পেছনে যাদের সম্পৃক্ততা আছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত, যাতে আগামিতে কেউ এমন ধংসাত্মক কর্ম করতে দুঃসাহস না দেখায়। একইসঙ্গে অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র মানুষদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নেয়াও জরুরি। উল্লেখ্য, অগ্নিকা-ে জীবন ও সম্পদহানির ঘটনা সাংবাৎসরিক। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর গড়ে অন্তত ১৬ হাজার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে দেশে। প্রায়ই বস্তি, গার্মেন্টস ও শিল্পকারখানায় অগ্নিকা-ের খবর পাওয়া যায়। অগ্নিকা-ে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে। চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে চলতি জানুয়ারি পর্যন্ত দুই বছরে চট্টগ্রাম জেলায় ১৩ শতাধিক অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকা-ের বেশিরভাগই হয়েছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটে। সর্বশেষ নগরীর মির্জাপুলের বস্তি এলাকায় সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি অগ্নিকা-ে কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উল্লেখ্য, ফায়ার সার্ভিস ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত চট্টগ্রামে পরিচালিত এক জরিপে নগরীর ৪২টি এলাকাকে অতিঝুঁঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তন্মধ্যে ১৩টি রয়েছে বস্তি ও কলোনি।

নাশকতা, জনসচেতনতার অভাবসহ নানা কারণে দেশে অগ্নিকা-ের ঘটনা আশঙ্কাজনকহারেই বেড়ে চলেছে। এসব দুর্ঘটনায় জীবনহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে প্রতিরোধমূলক তৎপরতা তেমন নেই বললেই চলে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে চলেছে। ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে প্রচুর। বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, সংঘটিত অগ্নিকা-ের ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে ঘটছে। কারণ বেশিরভাগ স্থানেই বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা অনেকটাই নাজুক ও উপেক্ষিত। পরিসংখ্যান মতে, যে পরিমাণ দগ্ধ রোগী হাসপাতালে যান, তাদের বড় অংশই বৈদ্যুতিক আগুনে পোড়া মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে সৃষ্ট অগ্নিকা-ের দুর্ঘটনাগুলোর অধিকাংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে উন্নতমানের বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ ইলেকট্রিশিয়ান দ্বারা ওয়্যারিংয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয় না। ফলে শর্টসার্কিটজনিত দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা দরকার। নিয়মিত বৈদ্যুতিক ও গ্যাসের লাইন এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাও প্রয়োজন। আর শুষ্ক মৌসুমে যেহেতু অগ্নিকা- বেশি ঘটে, সেহেতু এ সময় সবারই বিশেষভাবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। গ্যাসের চুলার ব্যবহারেও সতর্কতা প্রয়োজন। এছাড়া বৈদ্যুতিক লাইন, সুইচ, ক্যাবল এসবের মধ্যে কোনো ত্রুটি দেখা দিচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারেও বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। সচেতন হতে হবে দিয়াশলাই, মোমবাতি, কয়েল, সিগারেট প্রভৃতি অগ্নি উদগারক বস্তুর ব্যবহারেও। মনে রাখতে হবে, দেশে বিদ্যুৎ ও আগুনের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিকা-ের ঘটনা এবং ক্ষয়ক্ষতিও বাড়ছে। এটি উদ্বেগকর। অগ্নিকা-ের এই দুর্ভাগ্যজনক চিত্রের অবসানে জনসচেতনতা সৃষ্টি, জলাধার সংরক্ষণসহ বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি নাশকতামূলক অগ্নিকা- প্রতিরোধেও থাকতে হবে কঠোর পদক্ষেপ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট