চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মুক্তি ও কল্যাণের পথ প্রদর্শক হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)

ড. মুহম্মদ আবদুল মান্নান চৌধুরী

৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩২ পূর্বাহ্ণ

দুনিয়ার মোহে অন্ধ মানব জাতিকে মুক্তি ও কল্যাণের পথ প্রদর্শনের জন্য মহান আল্লাহ্তালা যুগে যুগে নবী ও রসুলগণকে এ ধরাধামে পাঠিয়েছেন। হযরত রসুল করিম (দঃ)-এর পর থেকে নবী ও রসুল আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং হযরত রসুল করিম (দ.) সর্বশেষ কিংবা আখেরী নবী হিসেবে রাব্বুল আলামীনের নিকট থেকে সনদপ্রাপ্ত হন। কিন্তু নবী প্রেরণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলেও মানুষের তমসার রাত কেটে যায়নি। মোহান্ধ মানুষকে মিথ্যা মোহ থেকে মুক্তি দেবার জন্য, আলোর দিশা দেবার জন্য এবং সুফিতত্ত্ব বা এল্মে তাসাউফ শিক্ষা দেবার জন্য পথ প্রদর্শক বা শিক্ষাগুরুর প্রয়োজনীয়তা থেকেই যায়। মহান আল্লাহ্তায়ালা এ পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করার জন্য যুগে যুগে গাউস, কুতুব বেশে হাদী বা পথ প্রদর্শক প্রেরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন। মহান আল্লাহ্ বলেন, “আমার সৃষ্টির মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় আসবে যারা পথভ্রষ্টদের সুপথ দেখাবেন” (আল-কুরআন)। মহান প্রভুর রেজামন্দি হাসিলপূর্বক তাঁর সাথে মহামিলনে যাঁরা ধন্য হয়েছেন, এল্মে তাসাউফের চর্চায় ও বিকাশে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এল্মে তাসাউফের চর্চার দ্বারা স্রষ্টার সাথে মহাসংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁদেরই একজন হলেন ইনসানে কামেল হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ)। তিনি এ ধরাধামে আগমন করেছেন পথহারা মুনষকে মুক্তির দিশা দেবার জন্য, মানুষের কলুষিত অন্তরকে পবিত্র করার জন্য এবং মানুষের মনের মধ্যে স্রষ্টা-প্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য। বলা বাহুল্য, প্রেমই হচ্ছে সকল প্রার্থনার মূল।
হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.) মানুষকে সকল মোহান্ধতার জাল ছিন্ন করে খোদা-প্রেমে এগিয়ে আসার জন্য তাঁর রূহানী শক্তির দ্বারা আকর্ষণ করেছেন। যে কোন ভক্ত তাঁর মাজার শরীফে একবার এসেছেন, তিনি দুনিয়ার মোহ পরিত্যাগ করে তাঁর মাজার শরীফের খেদমতে বারবার আসার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মাজার শরীফে একবার আসার সাথে সাথে ভক্তের হৃদয়ের সাথে তাঁর হৃদয়ের এক অভিনব সংযোগ স্থাপিত হয়ে যায় এবং ভক্ত সমস্যার সমাধান পায়। বলা বাহুল্য, ভালাবাসাপূর্ণ হৃদয় নিয়ে যে কোন ভক্ত হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ)-এর সাথে রূহানী সংযোগ স্থাপনে সক্ষম হবেন। খোদার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রয়োজন শুধু ভালবাসা ও একাগ্রতার। মাওলানা রুমী (র.) বলেন, “ভক্তি ও মহব্বতের সাথে একটি মহান হৃদয়ের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারলে ‘হজ্বে আকবর’ এর সওয়াব পাওয়া যায়। কারণ, হাজার হাজার কাবার চাইতে এরূপ একটি কাবা শ্রেষ্ঠ।”

হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.) একজন উচ্চ মার্গের ওলী ছিলেন। তাঁকে “বার আউলিয়াদের একজন বলে গণ্য করা হয়।” হযরত মাওলানা আহছান উল্লাহ্ (র.), হযরত মাওলানা সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভা-ারী (ক.) [প্রকাশ বাবা ভা-ারী] এবং শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভা-ারী (ক.)-এর রহস্যজনক উক্তি বা কার্যক্রম থেকে হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)-এর মর্যাদার স্তর সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা করা যায়। হযরত মাওলানা আহছান উল্লাহ্ (র.) ছিলেন মুক্ত বেলায়তের প্রতিষ্ঠাতা গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভা-ারী (ক.)-এর পীর ভাই। আজ থেকে প্রায় ৯৬ বছর পূর্বে তিনি হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)-এর মাজারের অভ্যন্তরের অবস্থা জানবার লক্ষ্যে তাঁর মাজার শরীফের পাশে বসে “কাশফুল কুবুর” নামক ধ্যান শুরু করেন এং জোহর থেকে আছর পর্যন্ত ধ্যানরত থাকেন।
ধ্যান শেষে তিনি সমবেত দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি দেখতে পেলাম তিনি একজন জিন্দা ওলী। কবরের ভেতরে তিনি কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করছেন।” এ প্রসঙ্গে পাক কুরআনে বর্ণিত মহান আল্লাহ্র বাণী প্রণিধানযোগ্য। মহান আল্লাহ্ বলেন, “যাঁরা আল্লাহ্র পথে শহীদ হয়েছেন তাঁদেরকে মৃত মনে করোনা, বরং তাঁরা জীবিত।” হযরত রসুল করিম (দ.) বলেছেন, “মৃত ব্যক্তিদের আত্মাসমূহ সবুজ বর্ণের পাখির মধ্যে থাকে। এ সকল পাখির বাসস্থান খোদার আরশের নীচে দোদুল্যমান রয়েছে।” এই বাণী থেকে বুঝা যায়, আত্মার মৃত্যু নেই। তাঁরা জীবিততুল্য।

হযরত মাওলানা শাহ্সুফি সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভা-ারী (ক.) [প্রকাশ বাবা ভা-ারী] হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ)-এ মাজার শরীফের আঙ্গিনায় এক নাগাড়ে সাতদিন অবস্থান করেছিলেন। তাঁর অবস্থানের স্থানটিকে “ঐতিহাসিক স্থান” হিসেবে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। হযরত বাবা ভা-ারী (ক.)-এর অবস্থানের পর থেকে হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)-এর মাজার শরীফের রওনক বৃদ্ধি পায়। শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভা-ারী (ক.)-ও হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)-এর মাজার শরীফে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন এবং পায়ে হেঁটে মাজার শরীফ প্রাঙ্গণ থেকে কিছু দূরে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মাজার শরীফের দিকে চেয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকেন কিছু সময়। বিভিন্ন ওলামায়ে কেরামগণও হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)-এর মহান মর্যাদার সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁর বহু অলৌকিক কেরামত এলাকার জনগণর মুখে মুখে। তাঁর অলৌকিক কেরামতসমূহ সাধারণের জ্ঞানের বাইরে। শুধু মানুষ নয়, জীব-জন্তু-ও হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বহু চাক্ষুষ ঘটনায় এর প্রমাণ মেলে। সৃষ্টিরাজির প্রতি তাঁর ভালবাসা হচ্ছে অতুলনীয়। যে কেউ অশ্রু বিগলিত হৃদয়ে তাঁর মাজারে আর্জি পেশ করেছে, সে তার লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম হয়েছে। সৃষ্টিরাজির প্রতি তাঁর এ প্রেম হচ্ছে স্রষ্টা প্রেমেরই ফলশ্রুতি। তিনি জিকিরের মাধ্যমে নিজ অস্তিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে চির সত্যের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মাওলানা রুমী (র.) বলেন, “হযরত ঈশা (আ.) যখন আল্লাহ্র নামে ফুঁক দিতেন, তখন আল্লাহ্র নামের মৃতরা হতো। কারণ তাঁর আত্মা আল্লাহ্র সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছিল। ইহা ছিল আল্লাহ্র জিকির, ইহা “হযরত ঈশা (আ.)-এর জিকির নহে।
‘আল্লাহ্’ ‘আল্লাহ্’ বলতে বলতে মানুষ আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিলীন হয়।” বলা বাহুল্য, হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ) ‘আল্লাহ্’ ‘আল্লাহ্’ বলতে বলতে আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন। হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.) মহান গাউস বা কুতুবুল আকতাব ছিলেন। হযরত মহিউদ্দিন ইবনুল আরবী (র.) বলেন, “গাউস হলেন বিশ্বব্রহ্মা-ের কেন্দ্র। তাঁর নিকট থেকে চারিদিকে আলো বিচ্ছুরিত হয়ে সমস্ত জীবের প্রাণে প্রবেশ করে।” হযরত রসুলে করিম (দ.) বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে এমন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোকও আছে, যে লোক গুণ-গরিমায়, হিম্মতে আমার সর্বগুণে গুণান্বিত।” বলা বাহুল্য, ওলীরা হচ্ছেন হযরত রসুলে করিম (দ.)-এর এ ধরণের উম্মত যাঁরা প্রকৃত বিধান ও আধ্যাত্মিক ধর্মের পরিপূর্ণ অনুসারী এবং পূর্ণতাপ্রাপ্ত। হযরত বড় পীর (র.) তাই বলেন, “যেহেতু তাঁরা আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁর প্রেমাষ্পদ হয়ে যান, তাঁদের কাছ থেকে আর কোন কিছুই গোপন রাখা হয় না। তাঁরা আল্লাহ্র জন্যই অপরকে ভালবাসেন এবং আল্লাহ্র জন্য অপরের সাথে শত্রুতা করেন। তাঁদের আপাদমস্তক সবই আল্লাহ্র এবং এতে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো অংশ নেই।” এতে বুঝা যায়, ওলীর শান বড়ই মহান। এতটুকু বেয়াদবীর সেখানে স্থান নেই। হযরত ইমাম গাজ্জালী (র.)-এর ভাষায়, “ওহে বেখবর! তুমি যদি আল্লাহ্র সাথে মিশতে চাও, তবে চিরতরে ওলীদের পায়ের ধূলা হয়ে যাও।”

হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.) চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল নন। মাওলানা রুমী (র.) কলেন, “কবরে শায়িত আল্লাহ্র অনেক বান্দা হাজার হাজার জীবিত ব্যক্তির চেয়েও অধিক উপকার করতে পারেন। তাদের কবরের মাটি মানুষের উপর ছায়াদাতা। লাখো জীবিত ব্যক্তিও এ কবরবাসীদের ছায়ায় রয়েছে।” হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)-এর মাজার শরীফ থেকে অবিরত বিচ্ছুরিত হচ্ছে আশার আলো ও খোদায়ী নূরের ঝলক। আশাহত হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত তাঁর রওজা মোবারকে ভীড় জমাচ্ছে তাদের সকল সমস্যার সমাধান পাবার জন্য, একটুখানি আলোর দিশা পাবার জন্য। কবির ভাষায়, “মধু না থাকিলে ভ্রমর তুমি ঘুর কেন?” যতদূর জানা যায়, হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)-এর মাজার শরীফে মনের আকুতি জানানোর সাথে সাথেই মনোবাসনা পূর্ণ হয়ে যায। কারণ ওলীরা সাধনার দ্বারা এমন এক স্তরে উপনীত হন, যখন “তাদের হাত আল্লাহ্র কুদরতের হাত, তাঁদের কান আল্লাহ্র কুদরতের কান, তাঁদের চোখ আল্লাহ্র কুদরতের চোখ” হয়ে যায়। মহান আল্লাহ্ বলেন, “হযরত রসুল করিম (দ.) নিজের থেকে কিছু বলেন না, তাঁর মুখ থেকে যা কিছুই বের হয়, তা সবই আল্লাহ্র বাণী” (সূরা নঈম আয়াত ৩-৪)।
প্রকৃত পক্ষে, ওলীগণ হচ্ছেন ঐ ব্যক্তি যিনি নিজের সত্তাকে বিলীন করে দিয়ে খোদার সত্তার সাথে একাত্মতা লাভ করেন। সত্যিকার ওলীগণ হচ্ছেন বিশ্বের হৃদয় ও প্রাণ স্বরূপ এবং সমগ্র বিশ্ব হচ্ছে তাঁদের দেহ বা আবরণ স্বরূপ। আগুনের স্ফুলিঙ্গের ক্ষেত্র যেমন লোহা, তদ্রƒপ খোদার তজল্লীর ক্ষেত্র হল বিশ্বের হৃদয়রূপ গাউসে জমান বা যুগের ওলী। সুতরাং, খোদার ওলীগণ হচ্ছেন খোদার জ্যোতিতে জ্যোতির্ময়। আর এমনি একজন জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ হচ্ছেন মহান ওলী হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)। তাঁকে পেয়ে আমরা সত্যি ভাগ্যবান। হযরত শাহজাহান শাহ্ হুজুর (র.) কে অন্তরে মহব্বতের সাথে স্মরণ করলে তিনি আমাদের আহ্বান সাড়া দেবেন এবং ফয়েজ রহমত বর্ষণে আমাদের মত পাপী-তাপীদেরকে কৃতার্থ করবেন। আমাদের অন্তরে যদি খোদার জিকির জারি হয়, আমাদের অন্তর যদি ওলী, রসূল (দ.) ও খোদা-প্রেমে সিক্ত হয়, তাহলে আমাদের অন্তর সকল প্রকার পাপাচার মুক্ত হবে।

খোদার সাথে আমাদের সংযোগ স্থাপিত হবে এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সকলকে ভালবাসতে শিখব এবং অসাম্প্রদায়িক হব। সারা বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হব। হযরত রসূলে করিম (দ.) কর্তৃক প্রদর্শিত এবং হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.) সহ সকল ওলী-বুজুর্গ কর্তৃক অনুসৃত পবিত্র ও মহান জীবনাদর্শকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করতে পারলে আমরা একটি সুখী ও সুন্দর জীবন লাভ করতে পারব এবং সকল প্রকার পাপাচার, সন্ত্রাস ও ভয়ভীতি থেকে মুক্ত থেকে হব ও পরকালীন মুক্তি লাভে ধন্য হতে পারব। জিকির বা প্রতিনিয়ত খোদা স্মরণের দ্বারা আমরা আমাদের হৃদয়-মনকে সত্যের আলোকে আলোকিত করব এবং অসত্যের জঞ্জাল মুছে ফেলতে পারব-আজ মহান ওলী হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)-এর পবিত্র বার্ষিক ওরশ শরীফে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। খোদা আমাদের এই মহৎ প্রচেষ্টায় সহায় হউন। আমিন!

ড. মুহম্মদ আবদুল মান্নান চৌধুরী : প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট