চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

পথশিশুদের পুনর্বাসন করুন

সিয়াম আহমেদ

৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩২ পূর্বাহ্ণ

একবিংশ শতাব্দীর তুমুল প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে আমরা যখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছি তখনও আমাদের ভবিষ্যৎপ্রজন্মের একটি বিরাট অংশ অন্ধকার তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে। যাদের সুবিধাবঞ্চিত আর্তনাদ আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। এরা হচ্ছে আমাদের সমাজের পথশিশু। এদের জীবন-জীবিকা, বেড়ে ওঠা সবকিছু পথে পথে। এরা সমাজের ন্যূনতম মৌলিক অধিকারটুকু থেকেও সদা বঞ্চিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত।

জাতিসংঘের সংজ্ঞানুসারে তাদেরই শিশু বলা যাবে যাদের বয়স আঠারো বছরের নিচে। যদিও বাংলাদেশের সরকার জাতীয় শিশু নীতিতে শিশুদের বয়সকে শূন্য থেকে চৌদ্দ পর্যন্ত— সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ৩৫ শতাংশেরও বেশি শিশু-কিশোর। এই বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোররাই আগামীদিনের ভবিষ্যৎ, জাতির কান্ডারি। তারাই হবে এই সোনার বাংলার ভাবী পরিচালক, পথপ্রদর্শক। কথায় বলে, আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

আজকের শিশুটিই একসময় বড় হয়ে অনেক বড় বিজ্ঞানী, মহান শিক্ষক, চিকিৎসক, জনপ্রিয় খেলোয়াড় বা চৌকস রাজনৈতিবিদ হয়ে উঠবে। আজকে যে শিশুটি হেসে-খেলে বড় হচ্ছে কাল সেই হবে এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতির অভিভাবক। তাই তো কবি গোলাম মোস্তফা বলেছেন, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’। সুতরাং এই দেশ ও জাতির মঙ্গলের কথা মাথায় রেখেই আমাদের শিশুদের প্রতি যতœশীল হতে হবে। আমাদের দায়িত্ব হবে প্রত্যেকটি শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। তাদের প্রয়োজনীয় শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের নীতিবান, সৎ, কর্মদক্ষ সচেতন নাগরিক তথা রাষ্ট্রের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা। কেননা একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও শক্তি হলো তার মানবসম্পদ।
সামাজিক সব অধিকার থেকে বঞ্চিত-উপেক্ষিত এসব শিশুদের পথে পথে ঘুরতে হয় কাজের সন্ধানে।

পেটের দায়ে দিনমজুরি, বাসের হেলপারি, কারখানা শ্রমিকের কাজ, রিকশা চালানো, চা-সিগারেট বিক্রি, টোকাইয়ের কাজ, ইট ভাঙা কত কাজই না এরা করে। এদের কারও ঘরে আবার ছোট ছোট ভাই-বোন, অসুস্থ মাও রয়েছে। এরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে আপনা থেকেই নিয়ম তৈরি করে নেয়। যেহেতু এদের দেখভাল করার কেউ নেই তাই তারা স্বভাবতই সঠিক পথের আলো থেকে অনেক দূরে অন্ধকারেই রয়ে যায়। প্রয়োজনীয় সচেতনতা, বিচারবুদ্ধি ও দিক-নির্দেশনার অভাবে প্রায়ই নিজেদের ভুল পরিচালিত করে। সমাজের অন্ধকারদিকের সঙ্গে গড়ে ওঠে ভয়ঙ্কর সখ্যতা। জড়িয়ে যায় মাদকের নীল জালে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে এসব পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই মাদকাসক্ত। এরা নিয়মিত মাদক গ্রহণ করছে। মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। একপর্যায়ে এসব অবহেলিতরাই হয়ে উঠছে বেপরোয়া। মাদকের পয়সা জোগাতে তৈরি করছে কিশোর গ্যাং। চুরি, ডাকাতি, হাইজেকিং, খুন ইত্যাদি অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে খুব সহজেই। অতঃপর এরাই একেকজন হয়ে উঠছে ভয়ংকর অপরাধী। এদের এসব কর্মকান্ড একদিকে যেমন এদের জীবন বিপন্ন করছে অন্যদিকে রাজধানীবাসী জনমানুষের নিরাপত্তাকে করছে বিঘিœœত।
সারা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব সতত উপেলিত পথশিশুদের যথাযথ পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব শিশুরও অধিকার রয়েছে আট-দশটা সাধারণ শিশুর মতো বেড়ে ওঠার। উপযুক্ত পুনর্বাসন, শিক্ষা ও মৌলিক অধিকার পেলে এরা হয়ে উঠবে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, দেশবরেণ্য সাহিত্যিক, সামাজসেবক কত কী! এতে এসব পথশিশুদের জীবনপথ পরিবর্তনের পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্রও লাভবান হবে। আমাদের একটু মানবতাই বদলে দিতে পারে তাদের এই অনিশ্চিত অন্ধকার জীবনের গতিপথ। পথশিশুদের পুনর্বাসনের মূল দায়িত্বটি সরকারকেই নিতে হবে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরির পাশাপাশি শিক্ষাসহ সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই তাদের সঠিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সম্ভব। এ ছাড়া সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসতে হবে একাজে। মনে রাখতে হবে, আমাদের ছোট ছোট মানবিক উদ্যোগগুলোই বদলে দিতে পারে এই সমাজ, এই দেশ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট