চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সিডিএকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা নির্বিচারে পাহাড় কাটা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ২:২৩ পূর্বাহ্ণ

অনুমোদনের বাইরে ১৫টি পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণের দায়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৫৩ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদফতর। গত বুধবার অধিদফতরের ঢাকা কার্যালয়ে শুনানি শেষে পাহাড় কেটে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, পাহাড়ের উপরিভাগের মাটি এবং ভূমির বাইন্ডি ক্যাপাসিটি নষ্টসহ পরিবেশ-প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করায় এই জরিমানা করা হয়। একই অপরাধে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের দিকেও সর্তক করার পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ গুণেও থামেনি সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি। ফলে প্রকল্প শেষের দিকে এসে বিপুল অংকের জরিমানা গুণতে হলো সিডিএকে। পরিবেশবিনাশী তৎপরতা চালালে যে কারো রেহাই নেই, পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কঠোর পদক্ষেপ সকলকে সে বার্তাই দেবে নিশ্চয়ই। সন্দেহ নেই, এটি একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কিন্তু প্রশ্নটি হচ্ছে, সিডিএ উন্নয়নের নামে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদনের বাইরে পাহাড় কেটে পরিবেশ-প্রতিবেশের যে ক্ষতি করেছে, তা কি এই অর্থদ-ে পূরণযোগ্য?

দৈনিক পূর্বকোণসহ বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী প্রকল্প প্রস্তাবনায় যত ঘনফুট পাহাড় কাটার অনুমোদন সিডিএ নিয়েছিল বাস্তবে তার থেকে ৬৯ হাজার ২১৯ দশমিক ৭০২ বর্গফুট বেশি কেটেছে। যে এঙ্গেলে কাটার কথা ছিল সেভাবে না কেটে ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে খাড়াভাবে কেটেছে। ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি যেকোনো মুহূর্তে পাহাড় ধসে মানুষের জীবনহানি ঘটতে পারে। উল্লেখ্য, বিগত ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে পাহাড় ধসে একদিনেই ১২৯ জনের প্রাণহানির পর পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনেও পাহাড় কাটার জন্য সিডিএকে দায়ী করা হয়েছিল। যেখানে নগরীর সৌন্দর্য্য বর্ধন, টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশ-প্রতিবেশের সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েই সিডিএ’র সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা সেখানে অপ্রয়োজনে অনমোদনহীনভাবে পাহাড় কেটে পরিবেশকে হুমকিতে ফেলার কোনো মানে থাকতে পারে না। রক্ষক যদি এভাবে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তাহলে পাহাড়খেকোরা তো বেপরোয়া হওয়ার দুঃসাহস দেখাতে দ্বিধা করবে না।

সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নির্লিপ্ততায় পাহাড়খেকোদের অপতৎপরতার শিকার হয়ে চট্টগ্রাম মহানগর ও আশপাশের এলাকার ৫৭ শতাংশ পাহাড় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পরিবেশবিনাশী এই অপকা-ে যুক্ত ছিল এবং আছে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, বেসরকারি সংস্থা, ইটভাটার মালিক, এমনকি সরকারি সংস্থাও। এভাবে নির্বিচারে পাহাড়কাটাসহ প্রকৃতিবিনাসী নানা অপতৎপরতার জের প্রায়ই পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে। প্রকৃত কারণ আড়াল করতে যদিও একটি মহল পাহাড়ধসের নেপথ্যে প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট কারণই যে মুখ্য তা তেমন প্রচার পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে নানা কারণে প্রশাসনের ভূমিকাও তেমন জোরালো নয়। আবার পাহাড়কাটা বন্ধে নানা সময়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সরকারি ঘোষণা থাকলেও তা বাস্তবায়নে দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। পরিণামে নির্বিচারে পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি নির্মাণ যেমন অব্যাহত আছে, একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘটছে পাহাড়ধস ও মৃত্যুর মিছিলও। পাহাড়খেকোরা শুধু সন্ত্রাসী কায়দায় পাহাড় দখল করে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বানিয়ে ভাড়া দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, পাহাড়ের মাটিও বিক্রি করে দিচ্ছে ইটভাটাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তির কাছে। পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশ হুমকিতে পড়লেও তাদের কিছুই যায়Ñআসে না। টাকাই তাদের কাছে মুখ্য। আর প্রশাসনের নির্লিপ্ততা তাদের অবৈধ কাজে উৎসাহ যোগাচ্ছে। মূলত প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকার কারণেই পাহাড়খেকোদের অপতৎপরতা বেপরোয়া রূপ নিয়েছে। এক সময় সংবাদপত্রের পাতায় পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি বিজ্ঞাপন দেখা যেতো। বিজ্ঞাপনটির শিরোনাম ছিল ‘পাহাড় বা টিলা কাটা এবং ঝুঁকিপূর্ণ বসতি নির্মাণ আইনত নিষিদ্ধ’। কিন্তু এখন এ ধরনের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে না। এ ধরনের বিজ্ঞাপন থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলেই হয়তো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তর ভাবছে খামাখা বিজ্ঞাপন দিয়ে পয়সা খরচ করার মানে হয় না। এদেশে যা ঘটবার তা তো ঘটছেই। তবে, আমাদের মতে, পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই।

কারণ পাহাড় কাটলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়, গাছপালা উজাড় হয়, পাহাড়ি কীট-পতঙ্গ এবং জীবজন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মেইন সয়েল নষ্ট হয়ে শস্য উৎপাদন হ্রাস এবং ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত হয়। সর্বোপরি পাহাড় ও টিলা কাটার পরিণতিতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়, পাহাড় ধসে অসহায় মানুষের নির্মম মৃত্যু হয়। সংগতকারণে আমরা চাই, পাহাড় সুরক্ষা ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতির বিরুদ্ধে সরকারের সময়োপযোগী কঠোর পদক্ষেপ। এ বিষয়ে কোনো আপোষ ও খামখেয়ালি জনকাম্য নয়। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াবার লক্ষ্যেও ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট