চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মদ-জুয়া নিষিদ্ধ হওয়ার পটভূমি

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

৩০ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:০৩ পূর্বাহ্ণ

মদ্য পান ও জুয়া খেলা দু’টোই নিষিদ্ধ ব্যাপার। দেশে দেশে এ সংক্রান্ত শক্ত আইন রয়েছে। ইসলাম ধর্মেও এ দু’টো নিষিদ্ধ ও অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত। কুরআন ও হাদীসে মদ ও জুয়া নিয়ে বিস্তারিত সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এ সব নিষিদ্ধ করার পটভূমি রচিত হয়েছিল-সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার কারণে অনেক সমাজদার ব্যক্তিদের মুখেও ইসলামের দৃষ্টিতে মদ ও জুয়ার উপকারিতার গন্ধ খোঁজে বের করতে দেখা যায়। পবিত্র কোরআনে মদ ও জুয়ার ব্যপারে পর্যায়ক্রমে তিনটি সিদ্ধান্তমূলক আয়াত নাযিল হয়েছিল। তন্মধ্যে তারা শুধু প্রথমটি উপস্থাপন করে। তা হলো এই, (হে প্রিয় নবী মুহাম্মদ স.) তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, এ দু’টোর মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে, তবে এ গুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়…..।- (বাকারা ২১৯)। আসলে এক লাফে যেমন গাছে উঠা যায় না, তেমনি ঘটা করে একটি শব্দের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের বিশ্বাসকে ভাঙ্গা যায় না। কোন প্রতিষ্টিত রেওয়াজ উচ্ছেদ করতে হলে এর জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও ধারাবাহিক পন্থা চাই। তাহলেই কেবল উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব, নচেৎ পরিস্থিতি ও বাস্তবতার সাথে সংঘাত অনিবার্য এবং প্রণীত আইন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য। যেমন ধরুন, ধুমপানের কথা। আজকের যুগে ধুমপান যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তা আর কাউকে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা। এ’টি পরীক্ষিত এবং এ ব্যাপারে সমস্ত ধর্ম, বিজ্ঞান ও বাস্তব মূল্যবোধ আজ একমত। কিন্তু তাই বলে তা হুট করে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে? হচ্ছে না। আস্তে আস্তে এ ব্যাপারে মানুষকে সর্তক করা হচ্ছে, স্থান ও পাত্র ভেদে নিষেধ করা হচ্ছে, এর আমদানী রপ্তানী নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এমন এক সময় হয়তো আসবে- যখন সব দিক বিবেচনা করে ধূমপানের ব্যাপারে সিরিয়াস সিদ্ধান্ত নেবে বিশ্ব নেতৃবর্গ।

মদ ও জুয়া সর্ম্পকে উপরোক্ত আয়াতটিও ছিল এ গুলো হারাম হওয়ার ব্যাপারে পূর্ব সতর্কসংকেত মাত্র। ইসলামের প্রথম যুগে জাহেলিয়াত আমলের সাধারণ রীতিনীতির মতো মদ্যপানও সাধারণ ব্যাপার ছিল। মহানবীর (স.) হিজরতের পরেও মদীনাবাসীর মধ্যে মদ্যপান ও জুয়া খেলার প্রথা প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষ শুধু এ দু’টো বস্তুর বাহ্যিক উপকারিতার প্রতি লক্ষ্য করেই এটির প্রতি উম্মত্ত ছিল। কিন্তু এগুলোর অন্তর্নিহিত অপকারিতা সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিলনা। তবে আল্লাহর নিয়ম এই যে, প্রত্যেক জাতিতে ও যুগে এমন কিছু মানুষ পয়দা করে দেন যাঁরা বিবেক-বুদ্ধিকে অভ্যাসের উর্ধ্বে স্থান দেন। যদি কোন অভ্যাস বুদ্ধি ও যুক্তির পরিপন্থী হয় তবে তারা এর ধারেকাছেও যান না। এ ব্যাপারে মহানবীর উদাহরণ তুলে ধরা যায়, তিনি যে সব বস্তু হারাম হবে- সে সব বস্তুর প্রতি আগে থেকেই অন্তরে ঘৃণা পোষণ করতেন। সাহাবাদের মধ্যেও এমন কিছু লোক ছিলেন যারা মদ হালাল থাকা কালীনও তা পানতো দূরের কথা, স্পর্শও করেননি। ওমর, মায়াজ (রাদি.) সহ তাদেরই কয়েকজন হযরতের খিদমতে হাজির হন এবং বলেন, মদ জুয়া মানুষের বুদ্ধি বিবেচনা পর্যন্ত বিলুপ্ত করে ফেলে এবং ধনসম্পদ ধ্বংশ করে দেয়। এ সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি ? এ প্রশ্নের উত্তরেই সূরা বাকারার উপরোক্ত আয়াতটি নাজিল হয়। উক্ত আয়াতে পরিস্কার ভাষায় মদকে হারাম করা হয়নি কিন্তু এর অনিষ্ঠ ও অকল্যাণের দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। বলতে গেলে আয়াটিতে মদ ও জুয়া ত্যাগ করার জন্য এক প্রকার পরার্মশ দেয়া হয়েছে। এ আয়াত অবর্তীণ হওয়ার পর কোন কোন সাহাবী তৎক্ষণাৎ পরার্মশ গ্রহণ করে মদ জুয়া ত্যাগ করেন, এ আয়াতে মদ জুয়াতো হারাম করা হয়নি, বরং পাপের দিকে ধাবিত করতে পারে বিধায় সতর্ক করা হয়েছে।

এ ভাবে কিছু দিন যেতে না যেতে একদিন সাহাবী আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাদি.) কয়েকজন সাহাবীকে বাসায় দাওয়াত করেন। আহারাদির পর মদ্যপানের ব্যবস্থা করা

হলো এবং সবাই মধ্যপান করলেন। এমতাবস্থায় মাগরিবের নামাজের সময় হলে সবাই নামাজে দাঁড়ালেন এবং একজনকে ইমামতি করতে এগিয়ে দিলেন। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় যখন তিনি সূরা ক্বাফিরুন, ভুল পড়তে লাগলেন তখনই একটি বিশেষ সময়ে মদ্যপান থেকে পুরোপুরি বিরত থাকার নির্দেশ এসে পড়লো। বলা হলোঃ ইয়া আইয়্যুহাল লাজিনা আ-মানু লা-তাক্বরাবুস সোয়ালাতা ওয়া আন্তুম সুকারা অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! নেশাগ্রস্থ অবস্থায় তোমরা নামাজের কাছেও যেওনা।’ এতে নামাজের সময় মদ্যপানকে হারাম করা হয়েছে তবে অন্যান্য সময় তা পান করার অনুমতি তখনও পর্যন্ত বহাল রয়ে গেল। কিন্তু ইতোমধ্যে তা অনেকেই পরিত্যাগ করতে শুরু করলেন। যেহেতু তা তখনও পুরোদমে নিষিদ্ধ হয়নি, সেহেতু কেউ কেউ নামাজের সময় ব্যতীত অন্যান্য সময়ে মদ্যপান করতে থাকেন।

এ পর্যায়ে আরো একটি ঘটনা সংঘটিত হয়ে যায়। আতবান ইবনে মালিক (রাদি.) কয়েক সাহাবীকে দাওয়াত করেন। যাদের মধ্যে সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসও (রাদি.) উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া দাওয়ার পর মদ্যপান প্রতিযোগিতা আরম্ভ হলো। আরব প্রথা অনুযায়ী নেশাগ্রস্থ অবস্থায় কবিতা প্রতিযোগিতা এবং নিজেদের বংশীয় আভিজাত্য ও পূর্বপুরুষদের গৌরবগাঁথা বর্ণনা করা হতো। সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন- যাতে আনসারদের দোষারোপ করে নিজেদের প্রশংসা কীর্তন করা হয়। ফলে একজন আনসার যুবক রাগান্বিত হয়ে উটের গন্ডদেশের একটি হাড় সাদের মাথায় ছুড়ে মারেন। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে সা’দ আঁ-হযরতের দরবারে উপস্থিত হয়ে উক্ত আনসার যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তখন হুজুর (স.) দোয়া করলেন ঃ আল্লাহুম্মা বাইয়্যিন লানা ফিল খামরি বায়ানান শাফিয়া- হে আল্লাহ ! শরাব সর্ম্পকে আমাদেরকে একটি পরিস্কার বর্ণনা ও বিধান দান কর। তখনই সূরা মায়িদার উদ্ধৃত মদ ও মদ্যপানের বিধান সম্পর্কিত বিস্তারিত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এতে মদকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করে বলা হয়েছে ঃ হে ঈমানদারগণ নিশ্চিত জেনো, মদ, জুয়া, আনসাব এবং তীর নিক্ষেপ-এই সব গুলোই নিকৃষ্ট শয়তানী কাজ। কাজেই এসব থেকে সম্পূর্ণ রূপে সরে থাকো। যাতে তোমরা মুক্তি লাভ ও কল্যাণ পেতে পার। মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে পারস্পারিক শত্রুতা ও তিক্ততা সৃষ্টি হয়ে থাকে, আর আল্লাহর জিকির ও নামাজ থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখাই হলো শয়তানের একান্ত কাম্য। তবুও কি তোমরা তা থেকে বিরত থাকবেনা ?

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট