চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

হত্যার ছক আঁকেন কাউন্সিলর সাবের

ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন সোহেল হত্যা ৫২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন

নাজিম মুহাম্মদ

২০ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:৪৩ পূর্বাহ্ণ

সাবের আহমদ নগরীর সরাইপাড়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। পাহাড়তলি বাজারে তার কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি পাহাড়তলি রেলওয়ে বাজার ব্যবসায়ী সমিতির আহ্বায়কের পদ আঁকড়ে ধরে আছেন। বাজারের দোকান দখল বেদখল ও কালোবাজারে চাল বিক্রিসহ নানা অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন কাউন্সিলর সাবের। তার এসব অনৈতিক কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ছাত্রলীগের উপ-শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক মহিউদ্দিন সোহেল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অনুসারিদের দিয়ে গণপিটুনীর নামে পুর্বপরিকল্পতভাবে মহিউদ্দিন সোহেলকে হত্যা করা হয়। সাবেরের নির্দেশে মহিউদ্দিন হত্যার পুরো নেতৃত্ব দেন সহচর পাহাড়তলির ভেলুয়ার দিঘির পাড়ের মৃত জামাল উদ্দিনের ছেলে ওসমান খান। কাঁচা বাজারের দিনমজুর দিয়ে প্রকাশ্যে দিনে দুপুরে উপুর্যপুরি ছুরিকাঘাত ও বেদড়ক পিটিয়ে মহিউদ্দিনকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর পর ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২’শ গজ দূরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিনের রক্তাক্ত দেহ। পুরো হত্যাকা-ের ঘটনার ছক আঁকেন কাউন্সিলর সাবের। হত্যা ঘটনার পর টানা দশমাস পুলিশের তদন্তে লোহমর্ষক এ চিত্র উঠে আসে। তদন্ত শেষে

গতকাল মঙ্গলবার মহিউদ্দিন হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডবলমুরিং থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জহির হোসেন। মামলায় কাউন্সিলর সাবের আহমদকে প্রধান আসামি করে ৫২ জনকে তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত করা হয়। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সকালে ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন সোহেলকে গণপিটুনীর নামে ছুরিকাঘাত ও বেদড়ক পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

নগর পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. কামরুজ্জামান জানান, মহিউদ্দিন সোহেল হত্যা মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৫২জনকে অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ১৯জনকে স্বাক্ষী করা হয়েছে। হত্যার দায় স্বীকার করে বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন দুইজন। ঘটনার পর থেকে পুলিশ ৩৫জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

যে কারণে সোহেলের উপর ক্ষিপ্ত কাউন্সিলর সাবের: চাঁদপুরের মতলব থানার আবদুল বারেকের ছেলে মহিউদ্দিন সোহেল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক পদে ছিলেন। এর আগে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তার বাবা রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ছিলেন। সোহেল রেলের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার ছিলেন। ঠিকাদারি ব্যবসার পাশাপাশি রেলের অনুমতি নিয়ে পাহাড়তলি রেলওয়ে স্টেশন পাওয়ার হাউস কলোনি এলাকায় এমএন ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সুবিধার্তে পাওয়া হাউস কলোনির চলাচলের সড়কের দ্ইুপাশে গেইট লাগিয়ে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি) স্থাপন করেন। এতে কাঁচাবাজারের মালামাল বহনের কাজে ব্যবহৃত ভ্যান রাখায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে ভ্যান চালকদের কৌশলে ক্ষেপিয়ে তুলে সাবের। পাহাড়তলি বাজার সংলগ্ন রেলের জায়াগা দখলে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জুয়ার বোর্ডসহ বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকা- পরিচালনা করতো কাউন্সিলর সাবেরের অনুসারি মনছুর। সাবেরের ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ এসবের প্রতিবাদ করার সাহস পেতোনা।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জুয়ার বোর্ড বন্ধ করে দিয়ে সেখানে জানাজার মাঠ করার ঘোষণা দেন সোহেল। এছাড়াও বাজারের নানা অনিয়ম নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে সাবেরের অনুসারি ওসমান খান, শওকত খান, শরীফ খান, শাহাদা খান রাসেলদের সাথে বিভিন্ন সময় মতবিরোধ দেখা দেয়। নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠে কাউন্সিলর সাবের। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে সোহেল হত্যার পরিকল্পনা ছক আঁকেন।

হত্যার ছক আঁকেন সাবের: চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় অনুসারিদের নিয়ে পাহাড়তলি কাঁচা বাজারের ইব্রাহিম সওদাগরের আড়তে বৈঠক করেন কাউন্সিলর সাবের। বৈঠকে ওসমান খান, আলাউদ্দিন মনা, আবদুর রশিদ মাঝিসহ প্রায় ২০ জন উপস্থিত ছিলেন। সেখানে পাওয়ার হাউস সড়কের দুপাশে গেইট লাগনোর বিষয়টি তুলেন ভ্যান চালকরা। ভ্যানচালকদের অভিযোগের বিষয়টি কাজে লাগায় সচতুর সাবের। তিনি পরদিন (৭ জানুয়ারি) সকালে মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে মিছিল করার ঘোষণা দেন। মিছিলে মহিউদ্দিন বাধা দিলে তাকে প্রয়োজনে মেরে ফেলার কথাও বলেন। বৈঠক শেষে পাহাড়তলি রেল স্টেশনের পাশে ইউসুফ স্কুলের মাঠে মহিউদ্দিনকে গণপিটুনীর নামে হত্যা করার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হয়।

মহিউদ্দিনকে যেভাবে হত্যা করা হয়: আদালতে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ৭ জানুয়ারি সকাল আনুমানিক সাড়ে আটটার সময় সাবেরের অনুসারি ওসমান খানের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ জনের একটি গ্রুপ পাহাড়তলি বাজারের খাজা হোটেলের সামনে জড়ো হয়। এ সময় মহিউদ্দিন সোহেল তার কয়েকজন বন্ধুসহ এমএন আইটি ফাউন্ডেশনের অফিসে বসা ছিলেন। সকাল আনুমানিক সাড়ে নয়টার সময় ওসমান তার দলবল নিয়ে মহিউদ্দিন সোহেলর অফিসে হামলা করলে মহিউদ্দিন ও তার বন্ধুদের বাধার মুখে তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। যাবার সময় সোহেলর বন্ধু রাসেলকে তারা ধরে নিয়ে যায়। এ সময় দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ওসমান খান ও সোহেল সামান্য আহত হয়। বিষয়টি জানতে পেরে সাবের আহমদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ওসমান খান ও নুরুন্নবী তালুকদার পাহাড়তলি বাজারের মাইকে সবাইকে দোকান বন্ধ করার আদেশ দেয়। তারা মাইকে বলেন, ‘বাজারে সবাই দোকান বন্ধ করুন। বাজারে চাঁদাবাজরা ঢুকেছে, যার যা আছে তা নিয়ে বের হন’। বাজারে চাঁদাবাজ আসার কথা শুনে ব্যবসায়ী, কর্মচারী, শ্রমিক সবাই বের হয়ে পুনরায় মহিউদ্দিনে সোহেলের অফিসে হামলা করে। প্রাণে বাঁচতে মহিউদ্দিন পাশের একটি ঘরের খাটের নীচে আশ্রয় নেন।

সেখানে থেকে টেনেহিঁচেড় বের করে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ওসমানের নেতৃত্বে মহিউদ্দিনকে বেধড়ক পেটানো হয়। একপর্যায়ে সড়কের উপর ফেলে মহিউদ্দিনকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে ওসমান খান ও তার অনুসারিরা। শ্রমিকরা তাদের হাতে থাকা বস্তা বহনের কাজে ব্যবহৃত হুক দিয়েও তার শরীরে আঘাত করে। পরে মহিউদ্দিনের মৃতদেহ ঘটনাস্থল থেকে আরো প্রায় ২০০ গজ দূরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে ফেলা হয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট