চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

১৩ বছর ঘুরে স্বজনের

সান্নিধ্যে ষ একটি মহামূল্যবান ফেসবুক স্ট্যাটাস ষ মায়ের মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারান

ইমরান বিন ছবুর

১৬ অক্টোবর, ২০১৯ | ৩:২২ পূর্বাহ্ণ

একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে ১৩ বছর পর নিজের পরিবার খুঁজে পেলেন এক ব্যক্তি। কুমিল্লা বরুড়া থানার জনৈক মোবারক হোসেনের মানসিক ভারসাম্যহীন পুত্র ফরিদ এতদিন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ওয়াহেদ আলী বাজারে ভবঘুরে হিসেবে ছিলেন। দীর্ঘদিন বাজারের বিভিন্ন দোকানের বারান্দায় রাত কাটালেও কখনো কারো সাথে কথা বলতেন না। তিনি যে লিখতে জানতেন তাও কেউ জানতো না। কেউ ডেকে খাবার দিলে খেতেন, না দিলে উপোস থাকতেন ফরিদ। তার কোনো চাহিদা ছিল না। বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, গত পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে হঠাৎ আনোয়ারা উপজেলার ওয়াহেদ আলী চৌধুরী বাজারে স্থানীয়রা তাকে দেখতে পান। মানসিক ভারসাম্যহীন লোকটি কারো সাথে তেমন কথা বলতেন না। তবে কখনো কাউকে গালি দেয়া বা কারো উপর হামলা করেননি। এমনকি কারো কাছ

থেকে কখনো খাবারও চেয়ে খাননি। সবসময় চুপচাপ থাকতেন। এলাকার লোকজনও তাকে পুরোপুরি পাগল ভাবতেন না। ব্যাপারটি এলাকার সবার নজরে আসতে শুরু করে। সেই হিসেবে প্রথমত তাকে স্থানীয় লোকজন ডেকে খাওয়াতেন। এরপর বাজারের প্রবীণ সাইকেল মেকানিক মফিজুর রহমানের কাছে থাকতে শুরু করেন লোকটি। এছাড়াও, সিএনজি ট্যাক্সি গ্যারেজের মালিক হামিদও তাকে ডেকে খাওয়াতেন। এরপর থেকে বাজারের সবার তার প্রতি মায়া জমে যায়। কোনো কথা না বলায় তার নাম ঠিকানা বা পরিচয় জানা যায়নি। ফরিদের ছোট ভাই বাবুল জানান, ২০০৩ সালে তাদের মা মইফুলের নেছা মারা যান। তখন মো. ফরিদ একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। মায়ের মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে শান্ত ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। বাবা এবং ভাই বিভিন্ন ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েও সুস্থ করতে পারেনি ফরিদকে। অস্স্থুতার কারণে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি তিনি। ২০০৪ সালের দিকে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় একদিন কুমিল্লার বরুড়া থানার গ্রোহালিয়া গ্রামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন ফরিদ। অনেক খোঁজাখুজির পরও সন্ধান পায়নি তার পরিবার। এক পর্যায়ে পরিবার তারা আশাও ছেড়ে দেন। ভেবেছিলেন, হয়তো ফরিদ আর বেঁচে নেই। এভাবে একে একে কেটে গেছে প্রায় দেড় দশক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা গত সোমবার আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ওয়াহেদ আলী বাজারে এসে নিজের ভাইকে নিজ গ্রামে নিয়ে যান। ছেলেকে নিতে এসেছিলেন ফরিদের বাবা মোবারক হোসেনও।

ঘটনার বর্ণনায় আনোয়ারা রায়পুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ইরফানুল ইসলাম কায়েস জানান, গত এক সপ্তাহ আগে বাজারের জামাল সওদাগরের দোকানের পাশে বসে কাগজ কলম নিয়ে কিছু লিখতে শুরু করেন ফরিদ। জামাল সওদাগর হাতে কাগজ নিয়ে দেখেন ফরিদ সেখানে তার নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, থানা, জেলা এসব লেখার চেষ্টা করছেন। বিষয়টি স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক নকুল শীল ও ফার্মেসী দোকানদার মিজানুর রহমানকে জানান। গত শনিবার সকালে মিজান তাকে নিয়ে গিয়ে খাতা-কলম দিয়ে তার বায়ো-ডাটা লিখতে বলেন। তিনি আস্তে আস্তে সেখানে লিখেন নাম-ফরিদ উদ্দিন, বাবা-মোবারক হোসেন, মাতা মইফুলের নেছা, গ্রাম গ্রোহালিয়া, থানা বরুড়া, জেলা কুমিল্লা। ফরিদের লেখা ঠিকানাটি লিখে বাজারের দোকানদার বাসিন্দা মিজান ফরিদের ছবিসহ ফেসবুকে পোস্ট করেন। তার পোস্টে তেমন কোন সাড়া না পড়লেও তা স্থানীয় শিক্ষার্থী ইরফানুল ইসলাম কায়েসের চোখে পড়ে। কায়েস সেটি শেয়ার করেন। কায়েস ফেইজবুকের বিভিন্ন গ্রুপ ও সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে পোস্টটি দ্রুত বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। রক্তকমল ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনের সাথেও যুক্ত কায়েস। এই সংগঠনের একজন এডমিন সানাউল আজিম মেহেদী; বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। তাকে এ ব্যাপারে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেন কায়েস। রক্তকমল ফাউন্ডেশন গ্রুপের সদস্যদের মাঝে ফরিদের ছবি, বিস্তারিত পরিচয় ও যোগাযোদের ঠিকানা লেখা একটা পোস্ট ছড়িয়ে দেয়া হয়। রক্তকমলের প্রতিটা সদস্য এতে কুমিল্লার প্রতিটি থানা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে খোঁজ নেয়া শুরু করে এবং রাত পৌনে ১২টায় ফরিদের পরিচয় পাওয়া গেছে জানিয়ে কায়েসের কাছে কল আসে।

ইরফানুল ইসলাম কায়েস আরো জানান, ‘রবিবার সকাল সাড়ে নয়টায় ফরিদের ভাই পরিচয়ে তার কাছে একটি ফোন আসে। এরপর ফোন আসে তার ভগ্নিপতি, ভাগনেসহ কয়েকজনের। এতে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হই তার পরিবার শনাক্ত করা হয়েছে। তারপর তাদেরকে আমাদের ঠিকানা দিয়ে আসতে বললাম। সোমবার দুপুর সাড়ে বারোটায় তারা কুমিল্লার বরুড়া থেকে আনোয়ারার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। আসার সময় পুরোটা পথ আমার সাথে ফরিদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ ছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ওয়াহেদ আলী চৌধুরী বাজারে এসে পৌঁছায়। বাজারের সওদাগর ও এলাকাবাসীর সহায়তায় ফরিদকে তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এসময় খবর পেয়ে এলাকার কয়েকশ মানুষ তা দেখতে আসেন। ফরিদকে নতুন জামা কাপড়ও কিনে দেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট