চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

১৫ বছর ধরে রাজত্ব আগ্রাবাদ এলাকায়

এতিম আলমের হাত ধরে অপরাধ জগতে খোরশেদ

নাজিম মুহাম্মদ

১৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ৩:৩২ পূর্বাহ্ণ

আগ্রাবাদে বন্দুকযুদ্ধে নিহত তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা খোরশেদের লাশ গতকাল সোমবার বিকেলে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কমার্স কলেজের সামনে বাদ আছর নামাজে জানাজা শেষে মোগলটুলীর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

নিহত খোরশেদ ৪ ভাই ৩ বোনের মধ্যে সবার বড়। স্কুলের গ-ি পেরুতে পারেনি খোরশেদ। দু’হাজার সালের পূর্বে মোমিন রোডের এতিম আলমের হাত ধরে অপরাধ জগতে পদার্পণ তার। ডবলমুরিং থানায় ২০০৪ সালে প্রথম তার বিরুদ্ধে ছিনতাই মামলা হয়।

এলাকাবাসী জানায়, তার দৃশ্যমান কোন ব্যবসা ছিল না। যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় দাপটের সাথে চলাফেরা করতো সন্ত্রাসী খোরশেদ। চাঁদাবাজিই ছিল তার মুল আয়ের উৎস। সাবেক একজন কাউন্সিলর ও মোগলটুলি এলাকার বাবুল নামের জনৈক প্রবাসী ছিল তার মূল আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা। প্রায় পনেরো বছরের অধিক সময় ধরে আগ্রাবাদ এলাকায় দাপটের সাথে সন্ত্রাসী আর র্চাঁদাবাজির কর্মকা-ে লিপ্ত ছিল খোরশেদ। নানা কারণে তার কাছে জিম্মি ছিলো আগ্রাবাদ মোগলটুলি এলাকার সাধারণ ও ব্যবসায়ীরা। নগরীর সদরঘাট, ডবলমুরিং ও কোতোয়ালি থানায় হত্যা, অস্ত্র ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে আটটি মামলা রয়েছে বলে জানান র‌্যাব। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা থেকে পশ্চিম মাদারবাড়ি পুরো এলাকা তার চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভয়ারণ্য। আগ্রাবাদ সাধারন বীমা ভবনের পেছনের গলিতে একটি কক্ষকে অফিসে হিসাবে ব্যবহার করতো খোরশেদ। মূলত চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ, কেউ কথার অবাধ্য হলে ধরে এনে মারধর, ইয়াবা সেবন সবই চলতো ওই কক্ষে। অনেকটা টর্চারসেল হিসাবে কক্ষটি ব্যবহার হতো। ওই এলাকাতে র‌্যাবের একটি টহল দলের সাথে গোলাগুলির ঘটনায় রবিবার রাতে নিহত হয় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী খোরশেদ আলম।

গতকাল সোমবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বীমা ভবনের পাশের সড়ক ও গলিতে তখনো হালকা রক্তের দাগ ছিলো। আশপাশের ব্যবসায়ীদের মাঝে বন্দুকযুদ্ধে খোরশেদের মৃত্যুর বিষয় নিয়ে তেমন কথাবার্তাও নেই। যে যার মতো স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করছে। আগ্রাবাদের ফুটপাতের জুতার দোকান, এক্সেস রোড, শেখ মুজিব রোড, পাঠানটুলি রোড, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, কমার্স কলেজ রোড, কাটা বটগাছ, জমির উদ্দিন লেন, মোগলটুলি বাজার, বার কোয়ার্টার, চৌমুহনী এলাকাজুড়ে চাঁদাবাজি করতো খোরশেদ। পুলিশের কয়েকজন উপ-পরিদর্শকের (এসআই) সাথেও তার বেশ দহরম মহরম সম্পর্ক ছিলো। খোরশেদ নিহত হলেও তার সহযোগীরা রয়ে গেছে। তাদের নিয়ে ব্যবসায়ীরা অনেকটা শঙ্কিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী জানান, আগ্রাবাদ এলাকার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফুটপাতে চাঁদাবাজি, কিশোর অপরাধী নিয়ন্ত্রণ সবকিছুই করতো খোরশেদ। কেউ তার কথায় দ্বিমত করলে তার অনুসারীদের দিয়ে ধরে নিয়ে সেই কক্ষে নির্যাতন করতো। কথায় কথায় গুলি কিংবা হাসতে হাসতে মানুষ খুন করতেও কোন দ্বিধা করতো না সন্ত্রাসী খোরশেদ।

ক্ষমতাসীন দলের একজন সাবেক কাউন্সিলর ও একজন প্রবাসীর ছত্রছায়ায় নানা অপরাধ করে বেড়াতো খোরশেদ।
মোগলটুলি জমির উদ্দিন লেনের পারভীন আক্তার জানান, ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল তার ভাতিজা শাকিব (১৪) মোগলটুলি বাজার থেকে ওষুধ নিয়ে জমির উদ্দিন লেইনের বাসায় ফিরছিলো। এসময় খোরশেদের অনুসারি মঞ্জুরুল আলম (২৬) কিশোর শাকিবের কাছে থাকা মোবাইল সেট কেড়ে নেয়। মোবাইল ফেরত চাইলে কিশোরকে চড় মারে মঞ্জুরুল। খবর পেয়ে কিশোরের মামা নুরুল আলম ঘটনাস্থলে পৌঁছে মোবাইল সেট ফেরত দিতে অনুরোধ করেন। তাতেও কাজ না হলে মঞ্জুরুলকে পুলিশে দেয়ার ভয় দেখালে ঘটে বিপত্তি। মঞ্জুরুল ফোনে খোরশেদকে বিষয়টি জানালে, খোরশেদ তার আরো সাত আটজন অনুসারী নিয়ে অস্ত্রসহ ঘটনাস্থল জমির উদ্দিন লেইনে উপস্থিত হয়। তাদেরকে দেখে কিশোর ও তার মামা দৌড়ে ঘরের ভেতরে চলে যায়। খোরশেদ অস্ত্র উঁচিয়ে প্রবেশ করে কিশোরের বাড়ির জিনিসপত্র ভাংচুর করে। পরিবারের সদস্যদের মারধরও করে। এক পর্যায়ে কিশোর শাকিব ও তার মামা নুরুল আলমকে গুলি করতে অস্ত্র তাক করলে তারা ঘরের গেইট বন্ধ করে দেয়। তাদের না পেলেও পর পর পাঁচ রাউন্ড গুলি করে খোরশেদ। খবর পেয়ে সদরঘাট থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও নাগাল পায়নি খোরশেদের। তবে ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা উদ্ধার করে। পারভীন আক্তার বাদী হয়ে খোরশেদ ও তার নয় অনুসারীর বিরুদ্ধে সদরঘাট থানায় মামলা দায়ের করলেও ধরা পড়েনি খোরশেদ।

খোঁজ নিয়ে জানাযায় আরেক পেশাদার সন্ত্রাসী গোলাম সরওয়ার প্রকাশ হামকা মিলনসহ তাদের ১০/১৫ জন সহযোগী নিয়ে মনির হোসেন মান্নান নামে এক ব্যবসায়ীকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন দিবাগত রাত একটায় কুপিয়ে হত্যা করে। থানায় দায়ের করা মামলায় মান্নানের বাবা আবুল হোসেন বলেন, ‘মনির কন্সট্রাকশন’ নামে মান্নানের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো। ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের ব্যবসা করতো।

২০১৪ সালের ২৯ জুন রাত এগারোটার সময় বন্ধু আসাদুজ্জামান রাজুসহ মোটর সাইকেল নিয়ে ঘরে থেকে বের হয় মান্নান। পরদিন (৩০ জুন ২০১৪) মোগলটুরি জমির উদ্দিন লেইনের হাবিবুর রহমানের বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের সাথে ঠেস দেয়া অবস্থায় মান্নানের ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার ডান হাতের কনুইয়ের নিচের অংশ শরীর থেকে প্রায় ১০ হাত দূরে পড়েছিলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত শরীরের বিভিন্ন অংশে এলোপাতাড়ি কোপানোর আঘাত ছিল।

আসাদুজ্জামন জানান, পৌনে এগারোটার দিকে তারা মোগলটুলি বাজারের কবরস্থানের পাশে খোরশেদের অফিসে যায়।

খোরশেদ তাদের বসিয়ে রাখে। প্রায় ১০ মিনির পর খোরশেদ ও হামকা মিলন ধারালো অস্ত্রহাতে রুমে প্রবেশ করে। তাদের সাথে আরো আট/দশজন ছিলো। খোরশেদের সাথে মান্নানের টাকা পয়সার বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে আসাদুজ্জামানকে পাশের একটি রুমে আটকে রেখে মুঠোফোন কেড়ে নেয়। রাত আনুমানিক পৌনে একটার সময় মান্নানকে অফিসের বাইরে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে গলিতে লাশ ফেলে রাখে। মান্নান হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে খোরশেদ ও তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদরঘাট থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি) মর্জিনা আক্তার। খোরশেদ ছাড়া সাতজনকে মান্নান হত্যায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন, হামলা মিলন (বর্তমানে কারাবন্দী), মাসুদ রানা বিপ্লব, রাশেদ আহমদ, ওসমান গণি, মুনসুর আহমদ, খোরশেদের ভাই রাজু আহমদ ও মো. ইসলাম। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুর্ব পরিকল্পিতভাবে মান্নানকে চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ সড়কের পাশে ফেলে দেয়। খোরশেদকে গ্রেপ্তার করার পর তার কাছে হত্যায় ব্যবহৃত চাইনিজ কুড়াল পাওয়া যায়। এ হত্যা মামলায় বেশ কিছুদিন কারাভোগও করেছেন খোরশেদ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট