চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মন্তব্য প্রতিবেদন

কার স্বার্থের বলি হলেন আবরার?

সন্দেহ কিংবা ভিন্নমতের জন্য কাউকে পিটিয়ে মারা যায়?

ডা. ম রমিজউদ্দিন চৌধুরী

৮ অক্টোবর, ২০১৯ | ৩:২৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করার প্রতিবাদ ও ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠেছে গোটা দেশ। ‘শিবির’ সন্দেহে স্ট্যাম্প দিয়ে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে আবরারকে। হত্যার জন্য অভিযোগের আঙুল ওঠেছে বুয়েট ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে।
আবরার হত্যার খবর চাউর হয়ে যাওয়ার পর বুয়েট ছাত্রলীগের এক নেতা গণমাধ্যমে স্বীকার করে বলেছেন, ‘তারা আবরারকে ডেকে নিয়েছিলেন হলের ২০১১ নম্বর ঘরে। তারপর তার মোবাইল ফেসবুক, মেসেঞ্জার চেক করা হয়। ‘বিতর্কিত’ কিছু পেজে লাইক দেওয়ার প্রমাণের পাশাপাশি কয়েকজনের সঙ্গে তার এসএমএস চালাচালিতেই তারা ‘বুঝতে পারেন’ আবরার শিবির করতো’।
এদিকে, রবিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে বুয়েটের চিকিৎসক ডা. মাসুক এলাহী ফোন পান। এসে দেখেন, আবরার নামের ছেলেটির প্রাণহীন নিথর দেহ সিঁড়ির কাছে পড়ে আছে।
ঘটনাটির ধারাবাহিক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ওই রুমে ডেকে নেয়ার পর তাকে শুধু জেরা-ই করা হয়নি এরপর আবরারের উপর প্রাণঘাতী বর্বর হামলাও চালানো হয়। আবরারের শরীর যার সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বলা হয়ে থাকে, বুয়েটে দেশসেরা মেধাবীরাই পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে থাকে। মেধাবীদের প্রতি আমাদের সকলেরই তাই এক ধরণের সমীহ ও শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। তারা দেশের সম্পদ। বিবেকের বাতিঘর। কিন্তু সেই মেধাবীরা যখন শুধুমাত্র সন্দেহের বশে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করে তখন আমাদের উৎকণ্ঠিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
আবরার হত্যার কারণ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত দুই ধরণের বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। একটি হলো- সে শিবির করতো। শিবিরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। অথচ গণমাধ্যমে প্রাপ্ত খবরে দেখা গেছে, কুষ্টিয়ার পিটিআই সড়কে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের বাসার পাশেই কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নে আবরারদের বাড়ি। আবরারের চাচা মিজানুর রহমান দাবি করেছেন, ‘সে (আবরার) শিবির কর্মী, এমন কথা রটাচ্ছে সবাই। এটা বানোয়াট, আমরা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক। হানিফ সাহেবের বিভিন্ন মিটিংয়েও আমরা যাই’।
আবরারকে হত্যার আরেকটি কারণ বলা হচ্ছে- ফেসবুকে দেয়া তার ভারতকে নিয়ে সমালোচনাধর্মী স্ট্যাটাস। তবে শেষোক্ত কারণটিই তার জন্য কাল হয়েছে বলে বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন। হামলার উপলক্ষ হিসেবে শুধু ‘শিবির সন্দেহের’ লেবাস লাগানো হয়েছে বলে তাদের ধারণা।
প্রশ্ন হচ্ছে, শিবির সন্দেহে আবরারের গায়ে হাত তোলার বিষয়টি কতোটা যুক্তিসঙ্গত হয়েছে? গতকাল যারা সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে চোখ বুলানোর সুযোগ পেয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, কোন একটি মানুষ এটিকে কোন বিচারেই সমর্থনযোগ্য মনে করেন নি। সকলেই একই প্রশ্ন করেছেন, ‘অপরাধীর’ গায়ে হাত তোলার অধিকার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? আবরারের হত্যাকা-টি যে দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন সহজভাবে নিতে পারেননি তা গতকালই পরিষ্কার হয়ে গেছে। বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি নিজেই গণমাধ্যমে এর তীব্র নিন্দা করেছেন এবং দোষীর শাস্তি দাবি করেছেন। তাছাড়া ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্ত করার কথাও বলেছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সংগঠনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই বহিষ্কার করা হয়েছে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ১১ জনকে। পুলিশ এদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনগণ যে মতামত দিয়েছেন, সেসব মতামত এক করলে এই দাঁড়ায়-ছেলেটির অপরাধ থাকতে পারে। অপরাধের শাস্তির জন্য দেশে আইন-আদালত আছে। আছে বিচার ব্যবস্থা। তার অপরাধের জন্য তাকে পুলিশে সোপর্দ করা যেতো। বুয়েট কর্তৃপক্ষকে জানানো যেতো। প্রশাসন আইনানুগ ব্যবস্থা নিত। কত পথইতো খোলা ছিল। সেসব না করে ছাত্রলীগ নামধারীরা কেন আইন নিজের হাতে নিয়ে বুয়েট কলংকিত করলো? কেন একটি ছাত্র সংগঠনকে বদনামের ভাগ নিতে হলো?
গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্নমত খুব স্বাভাবিক একটা প্রবণতা। শক্ত যুক্তি থাকলে সেই মতকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে কেউ বাধাগ্রস্ত হয়েছেন, এমন অভিযোগ সচরাচর শোনা যায় না। মত পাল্টা মতের চর্চা এদেশে প্রতিনিয়ত হচ্ছে। এটা বাধা দেয়ার কোন সুযোগ নেই। মেধাবীরা ভিন্নমতকে চ্যালেঞ্জ করতে মেধাভিত্তিক পথে না গিয়ে কেনো পেশীশক্তি দেখাতে গেলো- এটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের এবং ভাববার বিষয়।
সরকার যখন নিজেদের ভাবমূর্তি গড়তে দেশে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে ঠিক সেসময়ে বুয়েট ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা কেন আবরার হত্যার মতো ঘৃণিত কাজটি করলো, সেটির নেপথ্যের কারণ খোঁজা সরকারের জন্য এখন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এর পেছনে কোনো গোষ্ঠীর ইন্ধন আছে কিনা, কী তাদের স্বার্থ- সেটা বের করে জাতির সামনে তুলে ধরলেই কেবল প্রশাসন তথা সরকারের দায়মুক্তি সম্ভব। নইলে, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরারের এমন মৃত্যু গোটা জাতির জন্য কলংকজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট