চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

এ যেন শায়েস্তা খানের আমল!

বিদ্যানন্দ’র এক টাকায় চিকিৎসা ও ওষুধ

তাসনীম হাসান

৪ ডিসেম্বর, ২০২০ | ১১:২০ অপরাহ্ণ

পাঁচ বছরের আয়াতের বেশ কয়েকদিন ধরে জ¦র। সঙ্গে আছে কাশিও। বাবার হাত ধরে তাই এই অসুস্থ শিশু এসেছিল বিদ্যানন্দ মা ও শিশু হাসপাতালে। মাত্র এক টাকায় চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি ওষুধ পেয়ে তো বাবা মোহাম্মদ আইয়ুব বিস্মিত। অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে এলোÑ‘এক টাকায় চিকিৎসা আর ওষুধ পাওয়া তো অষ্টম আশ্চার্যের মতো’।

শুধু মোহাম্মদ আইয়ুব নন, এভাবে প্রতিদিন এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী আর তাঁদের স্বজনদের মুখে হাসি ফুটছে এক টাকায় সেবা পেয়ে। গত ২০ নভেম্বর থেকে নগরীর পাহাড়তলীর সাগরিকা রোডের বাইন্নাপাড়ায় প্রিমিয়ার বিশ^বিদ্যালয়ের ৭ তলা বিশিষ্ট ছাত্রীনিবাসে অসাধারণ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত বিদ্যানন্দের উদ্যোগে চালু হয়েছে এই হাসপাতাল। এরপর গত ১৩ দিনে হাজারো রোগী চিকিৎসা পেয়েছেন এই হাসপাতালে। বিদ্যানন্দের আশা প্রতিমাসে অন্তত ১০ হাজার মা ও শিশুকে তারা চিকিৎসা দেবেন। সারাবছর নানা মানবিক কাজ পরিচালনার জন্য ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনে’র সুনাম সারা দেশেই। করোনার প্রকোপ শুরু হলে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলে সংগঠনটি। পরবর্তীতে রোগীর অভাবে সেই হাসপাতাল বন্ধ হলে মা ও শিশুদের জন্য একটি হাসপাতাল চালু করার কথা ভাবেন সংগঠনটির উদ্যোক্তারা। বিদ্যানন্দের সেই উদ্যোগের কথা জানতে পেরে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির সাত তলা ছাত্রীনিবাসটি তাদের ব্যবহার করতে দেওয়ার আগ্রহ দেখান। পরে ২০ নভেম্বর সেই হাসপাতালটির উদ্বোধন করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী।

সম্প্রতি হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, চার তলা পর্যন্ত প্রস্তুত রাখা হয়েছে চিকিৎসার জন্য। এরমধ্যে নিচ তলায় রোগীদের নিবন্ধন করা হয়। দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে চিকিৎসকেরা রোগীদের সেবা দেন। তার পাশেই ১০ আসনের জরুরি বিভাগ। সেখানে অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ যাবতীয় সেবা কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। আছে আলাদা অস্ত্রোপচার কক্ষও। একটি কক্ষে শুধুমাত্র দাঁতের রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয় তলার আটটি কক্ষে ১৬টি বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে শুধুমাত্র কোভিড রোগীদের জন্য। চার তলায় ২১ শয্যার জেনারেল ওয়ার্ড যেন অপেক্ষা করছে রোগীর জন্য।

আপাতত পুরোদমে চালু হয়েছে আউটডোর সেবা। চারজন চিকিৎসক সার্বক্ষণিক পরম মমতায় রোগীদের দেখভাল করে যাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে মনের আনন্দে দিনভর খাটার জন্য ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবক তো আছেনই। তারা রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে আসা, চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে যাচ্ছিলেন ক্লান্তিহীনভাবে। আর সবাইকে সমন্বয় করে যাচ্ছিলেন জামাল উদ্দিন।

রোগীদের সেবা দেওয়ার বিরতিতে পূর্বকোণের মুখোমুখি হন এক টাকায় চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমের প্রধান চিকিৎসক আসমা আখতার। তিনি বলেন, প্রায় সব সমস্যার জন্য মা ও শিশুরা আসছে। বিশেষ করে মৌসুমি রোগের রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া দাঁতের সমস্যা, ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগীও আসছেন প্রচুর। প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জনের মতো রোগী হচ্ছে।
সাগরিকা এলাকায় ‘জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে’র মতো আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের অবস্থান হলেও আশপাশটা যেন এখনো আছে অন্ধকারে। এখানে থাকা বেশ কয়েকটি জেলে পল্লী ও বস্তিতে বসবাস করেন দারিদ্রপীড়িত লাখো মানুষ। তাদের জন্য এলাকায় এতদিন ছিল না কোনো দাতব্য হাসপাতাল। তাই স্বাভাবিকভাবে এক টাকায় চিকিৎসা নেওয়ার জন্য এমন একটি হাসপাতাল পেয়ে সবাই খুশি।

পাহাড়তলী মোড় এলাকার একটি বস্তির বাসিন্দা ছকিনা বেগম নামের এক মধ্যবয়সী নারী এসেছিলেন ওষুধ নিতে। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, টাকার সমস্যার জন্য চিকিৎসা নিতে পারছিলাম না। পরে হাসপাতালটির কথা জেনে ২৩ নভেম্বর বুকের ব্যথার সমস্যার বিষয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছিলাম। যেসব ওষুধ দেওয়া হয়েছে তা খেয়ে এখন অনেকটা ভালো অনুভব করছি। ওষুধ শেষ হওয়ায় পুনরায় ওষুধ নিতে এসেছি। এক টাকায় চিকিৎসা সেবা আর ওষুধ পেয়ে মনে হচ্ছে শায়েস্তা খানের আমলে আছি’।

হাসপাতালটির নিচ তলায় বসে এই অসাধারণ উদ্যোগের পেছনের গল্প শোনান সমন্বয়ক জামাল উদ্দিন। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘হাসপাতালে তো সবসময় চিকিৎসা মিলছেই। পাশাপাশি ঘরে ঘরে গিয়ে চিকিৎসা দিতে আশপাশের এলাকায় চষে বেড়াচ্ছেন আমাদের চিকিৎসক আর স্বেচ্ছাসেবীরা। রোগীর সংখ্যা বাড়লে হাসপাতালে অন্যান্য ওয়ার্ডগুলোও চালু হবে’।

কতদিন চলবে এই হাসপাতালÑএমন প্রশ্নে জামাল উদ্দিনের মুখে ম্লান হাসি। বললেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের সহায়তায় বিদ্যানন্দের কার্যক্রম চলে। মানুষ যতদিন সহায়তা করে ততদিনই এই হাসপাতাল চালু থাকবে’।

 

পূর্বকোণ/এন.এইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট