চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অসম্ভবকে জয় করে সফল উদ্যোক্তা

তাসনীম হাসান 

৩ ডিসেম্বর, ২০২০ | ১:৪৪ অপরাহ্ণ

সন্ধ্যা আসন্ন। একটু পরেই নামবে অন্ধকার। এর মধ্যেই বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারের ফাঁকে ঢুকে পড়ে একটি পাখি। সময় গড়াতে থাকে, কিন্তু পাখিটা বের হয় না। সেই পাখিটার কী হলো? এমন কৌতুহল ছোট্ট বাহার উদ্দিন রায়হানকে নিয়ে যায় খুঁটির চূড়ায়। তারপর! তারে হাত লাগতেই সব শেষ। বিকট শব্দে এক ঝাপটায় ছিটকে পড়েন নিচে। ১৬ দিন পর যখন হাসপাতালের বেডে রায়হানের জ্ঞান ফেরে- তখন দেখতে পান তাঁর দুই হাত আর নেই; পুরো শরীর মোড়ানো সাদা ব্যান্ডেজে।

২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবরের সন্ধ্যটা ঠিক এমন বিভীষিকা হয়েই এসেছিল রায়হানের জীবনে। যে আঘাতে রায়হানের বাম হাত পুরোটাই কাটা পড়েছে। ডান হাতের কনুই পর্যন্তও শরীর থেকে নাই হয়ে গেছে। এক পায়ে আঘাতের ধকল আজও এত স্পষ্ট যে এখনো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না তিনি। আরেক পায়ের দুটো আঙ্গুলও তার নেই।

আপাতদৃষ্টিতে পঙ্গু রায়হান এত কিছুর পরেও দমে যাননি। মুখ ও হাতের কনুই দিয়ে লিখে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে রায়হান এখন পড়ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের  স্নাতক শেষ বর্ষে। পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন অ্যাপভিত্তিক অনলাইন রেস্তোরাঁ-‘খাবার লাগবে।’ পর্যটকদের পথ দেখাতে খুলেছেন ওয়েবসাইট ‘কেমনে যাব ডটকম’। এসব থেকে ভালো আয়ও হচ্ছে তাঁর।

বিভীষিকার সেই দিন

১৬ বছর আগের সেই স্মৃতি এখনো তাঁজা রায়হানের কাছে। গতকাল বুধবার পড়ন্ত বিকেলে পূর্বকোণের কাছে সেই দুঃখের গল্প শোনাতে রায়হান যেন ফিরে গেলেন সেই দিনে। তখন পড়ছিলেন পঞ্চম শ্রেণিতে। তিনি গর্ভে থাকতেই মাকে ছেড়ে বাবা চলে যান। তারপর থেকে মা খালেদা বেগমের সঙ্গে রায়হানের ঠিকানা হয় নানু বাড়ি চকরিয়ার উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের জহিরপাড়ায়। শবে বরাতের দিন ঘুরতে গিয়ে নানুবাড়ির পাশের বৈদ্যুতিক খুঁটির ট্রান্সফরমারে পাখি ঢুকে পড়ার দৃশ্যটি দেখেন তিনি।

বাকিটা শোনা যাক রায়হানের মুখ থেকেই। তিনি বলেন, ‘ছোটকাল থেকেই দুরন্ত ছিলাম। এ গাছ থেকে ওই গাছে উঠাই ছিল কাজ। সেই অভিজ্ঞতা থেকে পাখিটিকে দেখতে উঠে পড়ি খুঁটির আগায়। ভেবেছিলাম বিদ্যুৎসংযোগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু বৈদ্যুতিক তারে হাত দিতেই ভুল ভাঙে। এরপর কী হয়েছিল জানি না।’

দুর্ঘটনায় ঝলসে যায় রায়হানের দুই হাতসহ শরীরের নানা অংশ। স্বজনেরা তাঁকে নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কয়েকদিনের মধ্যে কেটে ফেলতে হয় হাত। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন ভারতে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাতে। কিন্তু ছোটকাল থেকেই দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে বড় হওয়া রায়হানের পরিবারের পক্ষে সেটি সম্ভব হয়নি। ছয় মাস পর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র মেলে তাঁর।

আবার শুরু পড়াশোনা

দুর্ঘটনায় হাত হারানোর পর মন খারাপ করে বসে থাকতেন রায়হান। একদিন এক খালাতো বোন তাঁকে তাঁতিয়ে দেন এই বলে, ‘পত্রিকায় তো সংবাদ দেখা যায় অনেকে পায়ে কিংবা মুখে লেখে পাস করেছে। তুইও সেভাবে চেষ্টা করে দেখ।’ অদম্য রায়হান সেই অনুযায়ী মুখে লেখার চেষ্টা শুরু করেন। কিছুদিনের মাথায় দেখা যায় লিখতে পারছেন তিনি। এরপর গ্রামের আল রায়েদ কমপ্লেক্সে দুই শ্রেণি পিছিয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। সেখানে পাঠ চুকিয়ে ২০০৮ সালে ভর্তি হন চকরিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। ২০১৪ সালে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে জিপিএ ৩.৪১ পেয়ে এসএসসি পাস করেন রায়হান। এরপর ২০১৬ সালে চকরিয়া কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ ২.৩৩ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। তারপরেই তাঁর সামনে খুলে যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা।

রায়হান বলেন, ‘শিক্ষকেরা আমার কষ্ট দেখে বলেন শ্রুতিলেখকের সাহায্য নিয়ে পরীক্ষা দিতে। কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত সেই সাহায্য নেইনি। কারণ এভাবে হলে মনের কাছে প্রশান্তি পেতাম না। এখন কষ্ট করে লিখে যে জিপিএ পাচ্ছি তাতেই খুশি।’

উদ্যোক্তা  হওয়ার স্বপ্ন

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরেই রায়হান নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথ খুঁজতে থাকেন। সেই চিন্তা থেকে খোলেন অনলাইনভিত্তিক ট্রাভেল গাইড-কেমনে যাব ডটকম। যেখানে আছে দেশের প্রায় ৯০০টি এলাকার বিবরণ। এই ওয়েবসাইটে কয়েক ক্লিক দিলেই সেসব পর্যটন স্পটে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া আর ঘোরার সব পথ বাতলে দেবে। মাসে প্রায় এক লাখ মানুষ এই ওয়েবসাইটে সার্চ করেন। এখান থেকে মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকা আয় হয় রায়হানের।

আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ আর নিজের জমানো টাকায় ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই রায়হান খোলেন ‘খাবার লাগবে’ নামে অ্যাপভিত্তিক রেস্তোরাঁটি। সেই প্রতিষ্ঠান বেশ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন ১৫০ মানুষের কাছে সরবরাহ করতো খাবার। কিন্তু এক করোনা সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল। রায়হান বলেন, ‘১৪ জন কর্মী আর ২৫ হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে অনলাইন রেস্তোরাঁটি চালু করেছিলাম। তবে করোনার কারণে আপাতত বন্ধ রাখতে হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার নেমে পড়ব।’

অবসরে রায়হান জীবনের গল্প শুনিয়ে অনুপ্রেরণা যোগান অন্যদের। নিজের নামে খোলা একটি ফেসবুক পেজে প্রতিদিন হাজির হন নানা ভিডিও নিয়ে। সেগুলোর কোনোটিতে থাকে হাত না থাকার পরেও কীভাবে তিনি দাঁত ব্রাশ করেন। কোথাও দেখানো হয় কীভাবে তিনি খাবার খান। আবার কখনো কখনো অসহায় মানুষকে সাহার্য্যরে আর্তিও জানান।

রায়হান বলেন, ‘ঠেকতে ঠেকতে সব শিখেছি। আমার কাছে এখন সবই সম্ভব।’ রায়হানের জীবনজুড়ে যেন নেপোলিয়ান বোনাপার্টের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘আমার অভিধানে অসম্ভব নামে কোনো শব্দ নেই’ ভীষণভাবেই সত্যি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট