চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

মায়ের কানের স্বর্ণ বিক্রির টাকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাই

সৌমিত্র চক্রবর্তী, সীতাকুণ্ড

১ ডিসেম্বর, ২০২০ | ১:৫০ অপরাহ্ণ

পাকিস্তানিদের অত্যাচার থেকে দেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে হবে- শুধু এই শপথ নিয়ে বাড়ির লোকদের অজান্তে মায়ের কানের স্বর্ণ বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। সেই যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজের পায়ে রকেট ল্যাঞ্চারের সেল লেগে আহত হয়ে এখনো ভুগছি।  তবুও ভালো লেগেছে যে দেশ স্বাধীন হয়েছিলো। দীর্ঘ যুদ্ধের পর দেশকে স্বাধীন করার সে অনুভূতি কাউকে বোঝানো যাবে না। কথাগুলো বলছিলেন সীতাকুণ্ডের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ১নম্বর সৈয়দপুর ইউনিয়নের বগাচতর গ্রামের বাসিন্দা মৃত সেকান্দর ভূঁইয়ার ছেলে সীতাকুণ্ড উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল মোস্তফা (খাজা)।

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬৮ সালে আমি মিরসরাইয়ের নিজামপুর কলেজে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে যাই। এসময় ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচন সংক্রান্ত রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করি। এসময় থেকেই পাকিস্তানিদের সাথে বাঙালিদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের অত্যাচারে পুরো জাতি তখন শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকের অপেক্ষায় এবং  ফুঁসতে থাকে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সেই ঘোষণা দিয়ে বললেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এ ভাষণ শুনে পুরো জাতি এক হয়ে যুদ্ধ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্ততি নিতে শুরু করে।

২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে পাক হানাদারদের নৃশংস অত্যাচারের ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। বিভিন্ন স্থান থেকে যুবকরা দলে দলে যুদ্ধে যোগ দিতে থাকে। তখন আমি ইন্টার মিডিয়েডের ছাত্র। ১৮ বছর বয়সে ঐ ডাকে আমিও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার শপথ নিই। কিন্তু বাড়ির লোকজন বাধা দিতে পারে এমন আশংকায় কাউকে কিছু না বলে গোপনে মা সখিনা বেগমের কানের স্বর্ণ বিক্রি করে টাকা নিয়ে যুদ্ধের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে যাই।

তিনি বলেন, ২৬ শে মার্চ সকালে একটি সূত্রে খবর পাওয়া যায় যে কুমিল্লা থেকে পাঞ্জাবিরা সাজোয়া যান নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। এমন খবর শুনে তাদের গতিরোধ করতে এবং বাধা দিতে বাঙালি সেনা সদস্যদের ১৭ জনের একটি দল চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাহাড় বেয়ে ভাটিয়ারী হয়ে সীতাকুণ্ড মহাসড়কে পৌঁছায়। তাদেরকে সহযোগিতা করতে যোগ দেয় বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা। আমিও বের হই। এর পর পাহাড়ি পথে রামগড় হয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার উদ্দেশ্যে ত্রিপুরা রাজের উদয়পুর পালাটানা ক্যাম্পে চলে যাই। সেখান থেকে গেরিলা যোদ্ধার ট্রেনিং নিয়ে পরে ১নম্বর সেক্টরে তখনকার প্লাটুন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের বিএসসির নেতৃত্বে বর্তমান সীতাকুণ্ড পৌরসভার মেয়র আলহাজ বদিউল আলমসহ আমরা একই দলে যোগ দিই। আমরা ছিলাম গেরিলা যোদ্ধা। দলের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানিদের উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে তাদের শক্তি দুর্বল করে দিতে কাজ করেছিলাম আমরা। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে অনেক বার মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছি। সীতাকু-ের কুমিরা, রামগড়, বারৈয়ারহাটসহ বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি স্থানে যুদ্ধে বেশ কয়েকজন সহকর্মীকে আমরা হারিয়েছি। মিরসরাইয়ের ইছাখালী মিয়াজান ঘাটের ওসমানপুরে আমাদেরকে ত্রিমুখী আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। এই যুদ্ধে আমরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমরা  যে যেদিকে পেরেছি সরে গেছি। তবুও একটি মিসাইলের আঘাতে আহত হই আমি। পরে জেনেছি যে দুই সঙ্গী মৃত্যুবরণ করেন’।

এসব স্মৃতি ভুলতে পারেননি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল মোস্তফা (খাজা)। বর্তমানে তাঁর সংসারে স্ত্রী ও এক ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। তাদের নিয়ে সংসার সামলানোর পাশাপাশি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছেন। অস্থায়ীভাবে ভারপ্রাপ্ত কমান্ডারের দায়িত্বও পালন করেছেন বলে জানিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে এটিই তৃপ্তির। কিন্তু এখনো শত্রুরা যখন দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তখন কষ্ট লাগে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট