২৮ নভেম্বর, ২০২০ | ৯:১৮ অপরাহ্ণ
রাজীব রাহুল
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর দক্ষিণ সাধনপুরের কুমারপাড়ার প্রবেশমুখেই ৭৫ বছর বয়সী গৈারাঙ্গ রুদ্রের ঘর। চাক ঘুরিয়ে কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে তৈরি করছিলেন মাটির পাতিল। অভাবের সংসারে ১৩ বছর বয়সে বাবাকে সাহায্য করতে গিয়ে সেই যে মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়ালেন, ষাট বছরেও সেই কাজ থেকে বেরুতে পারেননি। এ পেশায় ঠিকমত সংসার চলে না। খেয়ে-না খেয়েই কাটে গৈারাঙ্গের জীবন। লেখাপড়া শিখিয়ে সন্তানদের যোগ্য করতে না পারার কষ্ট তাকে অহর্নিশ পুড়িয়ে মারছে। ভিন্ন পেশায় যাওয়ার পুঁজি ছিল না বলে পরিবর্তন করতে পারেননি পেশা। এখন অবশ্য ফেরার আর বয়স-সুযোগ, কোনোটিই নেই। ভাঙাচোরা বেড়া আর আংশিক মাটি দিয়ে ঘেরা বাড়ির উপরের টিনের ছাউনি দিয়ে দিনের বেলায় উঁকি দেয় রোদ। বর্ষায় বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে যায়। পৈত্রিক পেশায় সংসার চলে না বলে চল্লিশোর্ধ ছেলে চালায় রিকশা। নিজের কন্যা সন্তান আর স্ত্রীর পাশাপাশি বাবা- মা’কে দেখতে হয়। কোনোমতে চলে ছেলের সংসার।
গৌরাঙ্গের ঘরের দক্ষিণ কোণে থাকেন মৃদুল রুদ্র। উঠোনের এককোণে খড়কাঠি দিয়ে চুলো জ্বালিয়ে মাটির হাঁড়ি পোড়াচ্ছিলেন তিনি। তাকে খড়ের যোগান দিয়ে সহযোগিতা করছিল মেয়ে জুইঁ। তাতেই চটেছেন মৃদুলের স্ত্রী আরতি বালা। করোনার কারণে আটকে গেছে জুইঁয়ের এসএসসি পরীক্ষা। ছেলে-মেয়েকে এই কাজ থেকে দূরে রাখতে চায় আরতি। বিয়ের পর থেকে পূজাপার্বণে তাকে কোনও বছর একটা ভাল শাড়ি কিনে দিতে পারেননি স্বামী মৃদুল রুদ্র। বলতে বলতে আরতি বালা হারিয়ে যান তার অতীতে। বলেন, বিয়ের আগে দেখেছি প্রতি বছর নবান্ন উৎসবের পর থেকে চার-পাঁচ মাস চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় বড় বড় মেলা বসত। তখন আমার বাবা-ভাইয়েরা গাড়ি ও নৌকা করে মাটির সামগ্রী নিয়ে যেত বিক্রি করতে। সরাসরি বিক্রি করত বলে লাভও হত। এখন মেলাও নেই, বিক্রিও নেই। পাইকারদের কাছে বিক্রি করে কত আর পাওয়া যায়! একটি মাটির ছোট হাঁড়ি তৈরিতে ১২ টাকা খরচ হলেও পাইকাররা কিনে নেয় ১৫ টাকায়। এ যেন পণ্ডশ্রমের পেশা।
মৃদুল রুদ্রের পাশে উঠোনের এককোণে বিশাল এটেল মাটির স্তুপ করেছেন পরিতোষ রুদ্র। অনেকটা আক্ষেপ করে তিনি বলেন, বছর সাতেক আগেও এক পিকআপ মাটি সংগ্রহ করতে চার-পাঁচশ টাকা লাগত। এই কয়েক বছরে মাটির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এক গণ্ডা জমির মাটি কিনতে হচ্ছে চার-পাচঁ হাজার টাকায়। সেই জমির ৮ ফুট নিচ থেকে এটেল মাঠি তুলে আনতে প্রতি পিকআপে খরচ হচ্ছে হাজার দেড়েক টাকা। কাঠ আর খড়ের দামও বেড়েছে । এতকিছুর পরও শুধু দাম বাড়েনি মাটির তৈরি সামগ্রীর। আগের মত মাটির জিনিসের চাহিদাও নেই। যার কারণে আয় কমে গেছে আমাদের। বর্ষা এলেই বেকার হয়ে পড়ি আমরা। তখন দাঁদনদারদের কাছে জিম্মি হয়ে যাই। মৌসুমে লাভের বেশিরভাগই যায় দাঁদনদারের পকেটে। পরিশ্রমের সুফল পাই না আমরা। তবে ইদানিং নতুন করে চাহিদার কিছু ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। যেমন নার্সারি ও ছাদবাগান করতে প্রচুর টবের অর্ডার আসছে। কিছু হোটেলে-রেস্তারায় মেজবানি আয়োজনে মাটির সামগ্রীর কদর বাড়ছে। কিন্তু আমাদের তো পুঁজি নেই কাঁচামাল কেনার। তাই ঘুরে দাড়াঁতেও পারছি না। যার কারণে বাজারটা দখল করছে প্লাস্টিক সামগ্রী। কোথায় যাবো, পৈত্রিক ভিটাতে বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে পড়ে আছি।’
বাঁশখালীর উত্তর ও দক্ষিণ সাধনপুর মিলিয়ে শতাধিক পরিবার কুমোরদের। উত্তর সাধনপুরের ৪০টি পরিবারের মধ্যে দু-চারটি ছাড়া সকলেই এ কাজ ছেড়ে দিয়েছে। পরিবর্তন করেছে তাদের পেশা। দক্ষিণ সাধনপুরের এই পাড়ায় ৬০টির মত পরিবার আছে তার মধ্যে ২০টি পরিবার এ পেশা ছেড়েছে। এক সময় চট্টগ্রামে প্রতিটি ঘরে বাঁশখালীর কুমারপাড়ার মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবহার ছিল। হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, মটকা, শানকি, থালা ও বাসনসহ বিভিন্ন মাটির সামগ্রী তৈরি করে রীতিমতো আনন্দেই চলত মৃৎশিল্পী বা কুমোরদের সংসার। আধুনিকতার প্রভাবে বর্তমানে এই স্থান দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন প্লাস্টিক, স্টিল, মেলামাইন ও সিলভার সামগ্রী।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাচাঁও আন্দোলনের সংগঠক ও পরিবেশবিদ আবদুস সোবহান বলেন, পরিবেশ বাঁচাতে ফেরাতে হবে মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) মাধ্যমে কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে তাদের সহযোগিতা করা যেতে পারে। একইসাথে নাগরিক জীবনেও মাটির সামগ্রীর ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্লাস্টিকের পাত্রের ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ এটা স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দুটোর জন্যই ক্ষতিকর। আগের মাটির কলসিতে জল খেতাম আমরা তখন দেখতাম কলসির নিচে একটা তলানি জমত যেটা আমাদের পেটে যেত না। বলে প্রয়োজনে সরকারি অর্থায়ন বা ঋণ দিয়ে তাদের সহায়তা করতে হবে। পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্য হলে সহজে নষ্ট হয়না। শত শত বছর ধরে মাটির নিচে এগুলো থেকে যায়। উদাহরণ হিসেবে কর্ণফুলী নদীর কথা বলা যায়, গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দর এই নদী ড্রেজিং করতে পারছে না। কারণ নদীর তলদেশে ১০ ফুটের মতো পলিথিন ও প্লাস্টিকের বর্জ্য জমে আছে। যেখানে আটকে যাচ্ছে ড্রেজার মেশিনের কাঁটা। নাগাল পাচ্ছে না মাটির। যার কারণে নদীর তলদেশে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে।
কুমারদের আর্থিক সহযোগিতার বিষয়ে কথা হয় অগ্রণী ব্যাংক এবং এ টু আই’র (a2i) ‘কৃষি ও পল্লী ঋণ সহজীকরণ’ প্রকল্প পরিচালক আনিসুল মোস্তফার সাথে। তিনি জানান, কুমাররা চাইলে কোনও প্রকার জামানত ছাড়াই স্থানীয় একজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে জামিনদার করে ন্যূনতম এক লাখ টাকা ঋণ পেতে পারে। সরকার পল্লী ঋণের আওতায় এসব মৃৎশিল্পী বা কুমারদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
পূর্বকোণ/এসএ-পিএফ-আরপি
The Post Viewed By: 209 People