চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

বিপন্ন মানুষ, ভীষণ ক্ষতি পরিবেশের

আবর্জনার পাহাড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি

৩০ বছরেও নেই স্যানিটারি ল্যান্ডফিল

তাসনীম হাসান

২২ নভেম্বর, ২০২০ | ১২:৫৩ অপরাহ্ণ

নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কেটে ফেলা হলেও কোথাও কোথাও ‘গড়ে তোলা’ হচ্ছে পাহাড়। প্রতিদিন সেই পাহাড়গুলোর উচ্চতা বেড়েই চলছে। তবে এসব পাহাড় পরিবেশের লাভের বদলে উল্টো ক্ষতিই করছে। কারণ এগুলো যে আবর্জনার পাহাড়।

এই আবর্জনার পাহাড় গড়ে তুলছে স্বয়ং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। প্রতিষ্ঠার ৩০ বছরেও সংস্থাটি স্যানিটারি ল্যান্ডফিল (স্বাস্থ্যসম্মত বর্জ্যাগার) নির্মাণ করতে পারেনি। ফলে উন্মুক্ত স্থানে ময়লা ফেলতে থাকায় এভাবে পাহাড় হয়ে গেছে। ময়লা জমাতে জমাতে বেশ কয়েকটি জায়গা ভরাট হওয়ায় সেখানে আর ফেলা যাচ্ছে না। এখন যে দুটি স্থানে আবর্জনা ফেলা হচ্ছে, সেগুলোতেও আর জায়গা খালি নেই। এমন পরিস্থিতিতে আগামীতে কোথায় ময়লা ফেলবে কিংবা স্যানিটারি ল্যান্ডফিল কবে হবে তা এখনো জানে না সংস্থাটি। চসিকের হিসাবে ৪১ ওয়ার্ড থেকে দৈনিক সবমিলিয়ে আড়াই হাজার টন ময়লা তারা সংগ্রহ করছে। খোলা আকাশের নিচে এভাবে ময়লা ফেলায় কেবল পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে না, আশপাশের বাসিন্দারা আছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

৩০ বছরেও হয়নি স্যানিটারি ল্যান্ডফিল

১৯৯০ সালের ৩১ জুলাই চসিক প্রতিষ্ঠা হয়। সে হিসাবে সেবা সংস্থাটি ৩০ বছর পার করে ফেলেছে। কিন্তু এখনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সেই সাবেকী পথেই হাঁটছে সংস্থাটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিষ্কাশনের নামে তখনকার নিচু এলাকা হিসাবে পরিচিত নাসিরাবাদে আবর্জনা ফেলতে শুরু করে তারা। এলাকাটি ভরাট হয়ে গেলে এর ওপর গড়ে ওঠে সুগন্ধা আবাসিক এলাকা। পরে নগরীর বায়েজিদের রৌফাবাদ এলাকায় ফেলা হতো আবর্জনা। সেখানেও তৈরি হয় আবর্জনার পাহাড়। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় এর পর থেকে হালিশহরের আনন্দবাজার ও বায়েজিদের আরেফিন নগরে বর্জ্য ফেলতে শুরু করে সংস্থাটি। মাঝখানে কালুরঘাট শিল্প এলাকায় ১১ একর জায়গাজুড়ে আবর্জনা ফেলে পাহাড় গড়ে তোলে সিটি করপোরেশন। তবে বর্তমানে সেখানে আর ময়লা ফেলা হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড ধরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের দিকে এগোতেই হাতের বাম পাশে চোখে পড়বে বিশাল পাহাড়। পরিচ্ছন্নকর্মীরা নগরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য এনে প্রতিদিন জড়ো করেন এখানে। এ কারণে ৯ একরের স্থানটিতে এখন ২০০ থেকে ২৫০ ফুট উচ্চতার পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। এই পাহাড়ের অদূরেই লোকালয়। পাশেই ছড়া। আবর্জনার ভাগাড় থেকে দূষিত তরল বর্জ্য গিয়ে মিশছে সেই ছড়ায়। ছড়ার পানি সেই বর্জ্য বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আশপাশের এলাকা ও বঙ্গোপসাগরে। সেখানে কথা হয় আনন্দবাজার এলাকার বাসিন্দা গরু খামারি জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, সবসময় তো দুর্গন্ধের উৎপাতে থাকি। মাঝে মাঝে এসব পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো হয়। তখন আশপাশের এলাকা কালো ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সেসময় শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। অন্যদিকে আরেফিন নগর এলাকায়ও তৈরি হয়েছে একই অবস্থা। ১৪ একরের এলাকাটিতেও আর ময়লা ফেলার জায়গা খালি নেই।

কিছুদিন পর এ দুটি জায়গাতে ময়লা ফেলা যাবে না বলে জানিয়েছেন চসিকের উপপ্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, বর্তমানে যে দুটি স্থানে ময়লা ফেলা হচ্ছে সেখানে দিনের পর দিন ময়লা জমতে জমতে ২০০ থেকে ২৫০ ফুট উঁচু পাহাড় হয়ে গেছে। মন্ত্রণালয়ে স্যানিটারি ল্যান্ডফিলের বিষয়ে জানানো হয়েছে। তবে তা নিয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তেমনি নতুন করে কোন জায়গায় ময়লা ফেলা হবে সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়নি।

ঝুঁকিতে পরিবেশ ও মানুষ

এই ময়লার ভাগাড়গুলো নিয়ে নানা সময়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি এ সময় দেখেছেন ডাম্পিং স্টেশনগুলো থেকে সৃষ্ট তরল বর্জ্য ছড়াখালের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এতে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি যেমন হচ্ছে তেমনি আশপাশের লোকালয়ের মানুষ চর্মরোগসহ বাতাসবাহিত নানা রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার নিম্নশ্রেণীয় অনেক মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে প্রতিদিন প্লাস্টিক ও অন্যান্য ধাতু খুঁজে বেড়ান। এতে তাঁরা আরও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন।

গতকাল যোগাযোগ করা হলে মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান পূর্বকোণকে বলেন, একটি পরিকল্পিত নগরীর জন্য যেমন পার্ক ও খেলার মাঠ থাকা প্রয়োজন, তেমনি সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও প্রয়োজন। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে মানুষ বাড়লেও এখনো ডাম্পিং স্টেশনগুলোকে উৎপাদনশীলতার কাজে লাগানো শিখতে পারেনি চসিক। এখন দ্রুত আবর্জনার ভাগাড়গুলোকে স্যানিটারি ল্যান্ডফিল হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। তখন বর্জ্য দিয়ে সার, গ্যাস, বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এটি করতে পারলে মানুষ ও পরিবেশ যেমন বাঁচবে, তেমনি সংস্থাটিও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।

চসিকের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন পূর্বকোণকে বলেন, ‘স্যানিটারি ল্যান্ডফিল নির্মাণ করার বিষয়টি শুরু থেকেই ছিল। তবে নানা কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলছি। তাদের পরিকল্পনা যাচাই করা হচ্ছে।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট