চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বেকার চেয়ারম্যান, তবু কোটিপতি

ইমাম হোসাইন রাজু

১১ নভেম্বর, ২০২০ | ২:০২ অপরাহ্ণ

নেই নিজস্ব কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। করেননি কোন চাকরিও। তবুও তিনি এখন কোটিপতি। বর্তমানে তাঁর আছে বিপুল সম্পদ। থাকেন নগরীর সুগন্ধা আবাসিক এলাকার কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাটে। চার ব্যাংকে লেনদেন হয়েছে ৭ বছরে ৭ কোটি ২৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। নগদে রয়েছে ৪ কোটি টাকা। এতসব কিছুরই মালিক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি ফটিকছড়ি উপজেলার দাঁতমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জানে আলম। যিনি মাত্র দুই মেয়াদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরই গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। যার সবকিছুই অবৈধ অর্জন বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানে।

এদিকে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় আলোচ্য ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীর দাখিলের নির্দেশ জারি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সাথে সরকারের কর্মসৃজন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের দালিলিক প্রমাণও পাওয়া গেছে দুদকের দীর্ঘ অনুসন্ধানে। যার বিষয়ে আত্মসাতকৃত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে দুদক কমিশন।

অন্যদিকে, অর্থ আত্মসাতের সহযোগিতা করায় এবং দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফটিকছড়ি উপজেলার সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (বর্তমানে- সহকারী প্রকৌশলী, সেতু/কালভার্ট প্রকল্প বিভাগ- মহাখালী) মো. তরিকুল ইসলাম এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসের সাবেক উপ সহকারী প্রকৌশলী (বর্তমানে- খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা) মো. কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সুপারিশ করেছে দুদক।

এর আগে ২০১৯ সালের ২ আগস্ট দৈনিক পূর্বকোণে ‘ফটিকছড়িতে কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের কোটি টাকা আত্মসাৎ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। যাতে তুলে ধরা হয় মৃত ব্যক্তি, শিক্ষক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রবাসী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, গ্রাম পুলিশ, পুলিশসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নামে একাউন্ট খুলে সরকারের কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইউজিপিপি) প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। যার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। দুদকের দীর্ঘ অনুসন্ধানেও মেলে এমন দালিলিক প্রমাণ। এরমধ্যে ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরের শ্রমিকের তালিকাতে নাম থাকা ৪১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দিন।

অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, ৪১ জনের কেউই শ্রমিক নয়। তাদের প্রত্যেকেই স্বাবলম্বী। যাদের কেউই এসব টাকা উত্তোলন করেননি কিংবা টাকা সংগ্রহ করতে ব্যাংক একাউন্টও খোলেননি তারা। বরং শ্রমিকের তালিকায় অর্ন্তভুক্তদের অধিকাংশই ভুয়া। শুধু তাই নয়, এসব মজুরি শ্রমিকদের হিসাবে জমা করার কথা থাকলেও প্রদান না করে ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে জমা করেন চেয়ারম্যান। এরমধ্যে শুধুমাত্র ফটিকছড়ির হেঁয়াকো শাখার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রকল্পের একাউন্ট থেকে ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৯৬৬ টাকা স্থানান্তর করে নিজ একাউন্টে রাখা হয়। যারমধ্যে ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর ৫ লাখ ২১ হাজার টাকা শ্রমিকদের হিসাব থেকে উত্তোলন করে দুইদিন পর ব্যক্তিগত একাউন্টে রাখেন তিনি।

যত সম্পদ বেকার চেয়ারম্যানের : ২০১১ সালের ১১ জুন প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জানে আলম। পরবর্তী মেয়াদেও তথা ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিলেও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে বর্তমানেও দাঁতমারায় জনসেবা করছেন তিনি।  দুদকের অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগেও জানে আলম ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু করতেন না। তবে চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন কোটিপতি। অভিযোগ- চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের তারাকো বন বিটের আওতাধীন বনের জমি দখলে নিয়ে মানুষ থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন করেছেন। গড়েছেন বিপুল সম্পদও। এর মধ্যে নগরীর সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় এএনজেড প্রোপার্টিজ লিমিটেড থেকে  প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যে একটি ফ্ল্যাটের তথ্য পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। পাওয়া গেছে চারটি ব্যাংক একাউন্টে থাকা প্রায় ১১ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন। দুদকের ধারণা, সবগুলো অর্থই অবৈধভাবে অর্জন করেছেন তিনি।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, সোনালী ব্যাংক ফটিকছড়ি শাখাতেই ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা। ফটিকছড়ির হেঁয়াকো শাখার প্রাইম ব্যাংকের একটি একাউন্টে মাত্র তিন বছরের অর্থাৎ ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালে লেনদেন হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এছাড়া, নগরীর লালদীঘির পূবালী ব্যাংকের একটি একাউন্টে চেয়ারম্যানের নামে আছে প্রায় চার কোটি টাকা এবং ফটিকছড়ির হেঁয়াকো শাখার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে নিজ একাউন্টে লেনদেন হয়েছে ২ কোটি ৭৬ লাখ ৫৪ হাজার ৭৫ টাকা। এরমধ্যে ২০১১-২০১২ থেকে ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরের প্রকল্পের ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৯৬৬ টাকা হস্তান্তর হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে। তবে দুদক বলছে, এ চারটি একাউন্টের পাশাপাশি আরও লেনদেনের তথ্য পাওয়ার কথা। যদিও ইতোমধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ জারি করেছে দুদক কমিশন।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট