চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

‘রেড চিটাগং’-এ হতাশা

ইফতেখারুল ইসলাম 

৭ নভেম্বর, ২০২০ | ১২:১৬ অপরাহ্ণ

নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্তহীনতা এবং প্রকল্পের ধারাবাহিকতার অভাবে হাটহাজারী দুগ্ধ ও গবাদি পশু উন্নয়ন খামারটি দীর্ঘ আড়াই দশকেও রেড চিটাগং কাউ (আরসিসি) এর জাত উন্নয়ন করতে পারেনি। ১৯৯৫ সালে আরসিসি’র জাত উন্নয়নের জন্যই এই খামার চালু করে সরকার। ২০১৯ সাল থেকে নতুন করে আবার জাত উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করেছে। তাতে এই খামারের আড়াই দশকের ফল শূন্যই বলা যায়।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হাটহাজারী দুগ্ধ ও গবাদি পশু উন্নয়ন খামারটি স্থাপন হয় ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে। উদ্বোধন হয় ১৯৯৫ সালের ২৮ নভেম্বর। প্রকল্পের আওতায় কয়েকবছর কার্যক্রম চলার পর প্রকল্পই বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় তিন বছর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে হস্তান্তর হলে আরসিসি’র জাত উন্নয়ন নিয়ে এখানে আর কাজ হয়নি। বিদেশি জাতের গরু লালন-পালন করা হয়। পরবর্তীতে বিদেশি জাতের এসব গরুর মধ্যে কিছু সাভারে অবস্থিত কেন্দ্রীয় গো প্রজণন কেন্দ্র ও দুগ্ধ খামারে (সাভার ডেইরি ফার্ম) পাঠানো হয়। আর কিছু নিলামে বিক্রি করা হয়। ২০১৯ সাল থেকে নতুন করে আবার আরসিসি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। ৮২ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই খামার থেকে পরে ছাগল উন্নয়ন খামারের জন্য ১৫ একর জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়। বর্তমানে খামারে অবকাঠামো আছে সাত একর জায়গার উপর। ঘাস চাষ করা হয়েছে ১২ একরে। চারণ ভূমি রাখা হয়েছে পৌনে ৯ একর ভূমি। এছাড়া এক একরের একটি পুকুর এবং ৫ একরের একটি জলাশয় আছে। অনাবাদি ও পাহাড়ি জমি আছে সোয়া ৩৩ একর জমি।

গবাদিপশুর সংখ্যা : দুগ্ধবতী গাভী আছে ১৯টি, শুষ্ক গাভী ৩৩টি, গর্ভবর্তী ২৬টি, বিভিন্ন বয়সী বাছুর আছে ৯৫টি। মোট ১৭৩টি গরু আছে।

প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য : মূলত ওপেন নিউক্লিয়াস ব্রিডিং পদ্ধতিতে আর সি সি জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ। গ্রামীণ অঞ্চলের দেশি গাভীকে আর সি সি বীজ দ্বারা কৃত্রিম প্রজণনের মাধ্যমে উন্নত বংশধর উৎপাদন ও তাদের দক্ষতা যাচাই। আরসিসি’র সর্বোৎকৃষ্ট এবং সর্বাধুনিক কৌশল ও প্রযুক্তির ব্যবহার। যেমন জিন রহস্য, অধিক ডিম্ব উৎপাদন ও ভ্রণ স্থানান্তর ইত্যাদি। মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষক (বিজ্ঞানী ও সহকারী কর্মকর্তা), কৃত্রিম প্রজণন কর্মী ও গাভী পালনকারী খামারি প্রশিক্ষণ। আরসিসি’কে প্রচারণার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরা এবং এটি জাত হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন।

খামারের বর্তমান সমস্যা : এই গবেষণা কেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য ৪৭টি পদ মঞ্জুর করা হয়। এরমধ্যে বর্তমানে ১১ টি পদ শূন্য পড়ে আছে। আবার এখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় প্রেষণে চলে গেছেন ৯ জন। বর্তমানে ২৯ জন জনবল কর্মরত আছেন। এমনকি এই খামারের এক নম্বর পদ পশু উৎপাদন কর্মকর্তার পদটিও শূন্য। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এখানে দায়িত্ব পালন করেন। খামার শুরু হতে যে ট্রাক্টরটি প্রদান করা হয়েছিল সেটি অকেজো হয়ে আছে। এমনকি মেরামত অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নতুন একটি হালকা ট্রাক্টর প্রয়োজন। খামারের চারণ ভূমি বাদে প্রায় সাড়ে ১২ একর ঘাসের জমি আছে। ছাগলের খামারের পাওয়ার ট্রিলার দিয়ে এই খামারের কাজ হয়। সেটিও পুরাতন হয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে একটি হালকা ট্রাক্টর ও একটি পাওয়ার ট্রিলার প্রয়োজন। খামারটি উপজেলা হেডকোয়ার্টার হতে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে হওয়ায় বিভাগীয় কাজে উপজেলায় আসা-যাওয়ার জন্য একটি মোটরসাইকেল জরুরি। পুরাতন মোটরসাইকেলটি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। খামারের পশ্চিম এবং উত্তর পশ্চিম পাশের সীমানা প্রাচীর নেই। পূর্ব এবং দক্ষিণ পাশে সীমানা প্রাচীর থাকলেও অনেক জায়গায় ভাঙ্গা এবং কাঁটা তার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বহিরাগত লোকজন সহজেই খামারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে। জৈব নিরাপত্তার স্বার্থে চারদিকে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা এবং নির্মিত অংশে কাঁটা তার সংযোজন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রকিবুর রহমান টুটুল পূর্বকোণকে বলেন, জাত উন্নয়ন এটা ধারাবাহিক কাজ। গরুর একটি জাতে উন্নয়ন করতে কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগে। তার চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে। রেড চিটাগং বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র জাত। এই গরুর জাত উন্নয়ন করা সময়ের দাবি। যেসময় হাটহাজারীর প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়েছিল, এতদিনে আমাদের একটি উন্নত রেড চিটাগং জাত পাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা পায়নি। হাটহাজারীর ওই দুগ্ধ ও গবাদি পশু উন্নয়ন খামার সম্পর্কে ধারণা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি তারা এতদিন পর আবার নতুন করে শুরু করে থাকে, আমার আবেদন থাকবে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে দেশবাসীকে  যেন একটি উন্নত জাত উপহার দেয়। তিনি তাঁর খামারে রেড চিটাগং এবং মুন্সিগঞ্জের মীর কাদিমের সাথে হলস্টন ফ্রিজিয়ান ক্রস বিড করে জাত উন্নয়নের চেষ্টা করছেন বলে জানান।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক পূর্বকোণকে বলেন, গবেষণার মাধ্যমে দেশীয় জাতের রেড চিটাগং গরুর জাত উন্নয়ন করা সম্ভব। তবে একটি জাত উন্নয়ন করতে অন্তত দুই দশক সময়ের প্রয়োজন। পর্যাপ্ত সময় পেলে যথাযথ গবেষণা করে একটি সফল জাত উন্নয়ন করা সম্ভব। দেশীয় জাতের গাভীতেও তখন বিদেশি জাতের গাভীর মত দুধ পাওয়া যাবে। তবে হাটহাজারী দুগ্ধ খামারে ধারাবাহিকতার অভাবের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এটা নির্ভর নীতি-নির্ধারকদের উপর। গবেষণাখাতে অর্থ ব্যয় করলে তা সাময়িকভাবে বোঝা মনে হলেও ভবিষ্যতের জন্য এটা সম্পদ। রেড চিটাগং গরুর জাত উন্নয়ন করা গেলে এই গরুর রোগ বালাই কম হবে এবং লালন-পালন খরচও বিদেশি জাতের গরুর চেয়ে অনেক কম হবে। কারণ এই জাত আমাদের নিজস্ব জাত। দেশি গরুর রোগ বালাই অনেক কম। তবে সাভার ডেইরি ফার্মে রেড চিটাগং জাতের উন্নয়ন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশি গরুর কৃত্রিম প্রজণনের ক্ষেত্রে সাভারের বীজ দেয়া বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।

জানতে চাইলে হাটহাজারী দুগ্ধ ও গবাদি পশু উন্নয়ন খামারের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত পশু উৎপাদন কর্মকর্তা ডা. মো. নাবিল ফারাবী পূর্বকোণকে বলেন, অতীতে কেন হয়নি তা তার জানা নেই। তবে জাত উন্নয়নের ধারাবহিকতা রক্ষা করা গেলে এই জাতটি উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এজন্য অন্তত এক দশক সময় দরকার। তিনি জানান, বর্তমানে রেড চিটাগং জাতের যেসব গরু আছে তা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেনা। এর আগে এখানে অন্যজাতের গরু ছিল।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট