চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

১৯৫৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের উদ্বোধন করা হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজই দেশের একমাত্র মেডিকেল কলেজ যার উদ্বোধনকালে জাতির পিতা তৎকালীন প্রাদেশিক মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন (বা-থেকে) কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ প্রফেসর আলতাফউদ্দিন, প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধীরেন্দ্রলাল দত্ত, প্রধানমন্ত্রী হোসেন সোহরাওয়ার্দী, জেলা মেজিস্ট্রেট এম এ রশিদ, পুলিশ সুপার, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জমিরউদ্দিন এবং প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হক, মুনাওয়ার আহমেদ এবং অন্যরা।

মাস্টারপ্ল্যান অবজ্ঞা করে চমেকে কেন এই ক্যান্সার ইউনিট!

ডা. ইমরান বিন ইউনূস

৭ নভেম্বর, ২০২০ | ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) দেশের দ্বিতীয় ও প্রাচীন এবং বৃহত্তম মেডিকেল শিক্ষা প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা কেন্দ্র। জাতির পিতার উপস্থিতিতে গণতন্ত্রের মানসপুত্র তখনকার দেশের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ সালে উদ্বোধন করেন। এই সৌভাগ্য আর কারও কপালে জুটেনি। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনে সমিতি আকারে হাসপাতাল তৈরি করে চালু করা হয় ১৯৫৯ সালে। গ্রিক সেলিব্রিটি আর্কিটেক্ট স্যার আর্থার মেকমিলানের কালজয়ী ডিজাইনে শুরু হয় পরিপূর্ণ হাসপাতাল নির্মাণের কাজ। বিধিবদ্ধতার কারণে একজন শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম ১০ জন রোগী এই হিসাবে ৫০ জনের জন্য ৫শ শয্যার হাসপাতাল। বর্তমানের পুরো পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকাসহ হাসপাতালের জন্য একশ’ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। তখন এখানে কোন জনবসতি ছিল না। ষাটের দশকের শুরুতে অবাঙালি ডিসি আর অন্যদের চক্রান্তে বরাদ্দকৃত জমিতে পত্তন করা হয় পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা, যেখানে বেশিরভাগই ছিল অবাঙালি।
অবৈধ দখলের কারণে জমি কমতে কমতে ২০০৬-এ আমি যখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলাম তখন ৬৫ একরে নেমে আসে। তিনটি উইংসহ মূল হাসপাতাল ১০ তলা হাসপাতাল ভবন এবং আলাদা আউটডোর ইমার্জেন্সি ইউটিলিটি কমপ্লেক্স পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের জন্য প্ল্যান আপাত সংকোচন করে মূল ভবন শুধুমাত্র একটা উইংসহ ৬ তলায় সীমাবদ্ধ করে হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হয়। সাত তলায় কিচেনের জন্য কিছু নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৯ সালে মেডিসিন ওয়ার্ডসমূহ স্থানান্তরের মাধ্যমে নতুন ভবনের কার্যক্রম শুরু হয়।
প্রসঙ্গতঃ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের একীভূত প্রতিষ্ঠান ছিল। পরবর্তীতে সামরিক শাসনামলে জেনারেল হাসপাতালকে আলাদা করা, সামরিক ব্রিগেডিয়ার এনাম কমিটি দিয়ে জনবল এক তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা হয় এবং কলেজ ও হাসপাতালের সমন্বিত ব্যবস্থাপনাকে নড়বড়ে করার প্রচেষ্টা চলমান হয়। কলেজ ভবনের মাস্টারপ্ল্যানকে অবজ্ঞা করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল লক্ষ্য, দায় ও দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে কলেজ ভবনের একাংশ ভেঙে ক্যান্সার ইউনিট করার খবর আর এ ব্যাপারে হাসপাতালের মুখোমুখি অবস্থান দেখে মনে পড়ছে এসব কথা। কারণ আমি এই কলেজের ১৫তম প্রজন্মের এবং ছাত্র থেকে সকল ধাপ পেরিয়ে এক পর্যায়ে অধ্যক্ষ হয়েছিলাম। কলেজ ও হাসপাতালের ৬৫ একর জমির প্রতি ইঞ্চিতে আমার পা পড়েছে, ছাত্র থেকে অধ্যক্ষ হওয়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে ক্যান্সার ইউনিট হতে হবেই। কিন্তু এভাবে মেডিকেল শিক্ষা আর চিকিৎসাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে কেন? ৫০ জন শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিকমানের এই স্থাপনা বার বার দূরদৃষ্টিবিহীন আর প্রজ্ঞাবন্ধী আমলাদের দ্বারা খ-িত হতে হতে বর্তমান অবস্থায় পরিণত হয়েছে। একটার পর একটা সমন্বয়হীন অনুপ্রবেশ, সঙ্গতিহীন শিক্ষার্থী ও শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এর সবটুকু সৌন্দর্য এবং টিচিং বলা যায় বিলীন হতে চলেছে। হাসপাতালের প্রায় সব বৈশিষ্ট হারিয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। তলানি যা আছে তাও হয়তো শিগগিরই সাফ হয়ে যাবে।
সবাই ভুলে যাচ্ছেন বা ভুলে থাকার ভান করছেন অথবা অজ্ঞ যে এটা কোন সাধারণ হাসপাতাল নয়। এটা টিচিং হাসপাতাল। এখানে ছাত্ররা রোগীর চিকিৎসার বাস্তব প্রশিক্ষণ নেবে, জ্ঞান-দক্ষতা-আচরণ সমৃদ্ধ হবে, গবেষণা করবে, থিসিস রচনা করবে, রোগ আর রোগীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করবে। চিকিৎসা হবে বাই প্রোডাক্ট। এর ধারাবাহিকতায় চিকিৎসা আর গবেষণায় বুৎপত্তি অর্জন করে জাতির জন্য নিরাপদ চিকিৎসক আর বিজ্ঞানী হবে।
শুরু থেকে হাসপাতালকে জেনারেল হাসপাতাল রূপে ব্যবহার করা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর নতুন নতুন এলাকাভিত্তিক জেনারেল ও বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা না করার আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ও জটিলতার কারণে এই হাসপাতাল চট্টগ্রাম আর আশেপাশের অনেক জেলার অগণিত মানুষের চিকিৎসার কেন্দ্র। যার ভিড়ের চাপে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে শিক্ষা প্রশিক্ষণতো দূরের কথা চিকিৎসারও পরিবেশ নেই। আমাদের জনমতবিদ, জনপ্রতিনিধি, নীতি নির্ধারক, ব্যবস্থাপক তথা জনগণের মাইন্ডসেট ও প্রনিধানযোগ্য। উনারা মেডিকেল কলেজ, বিশেষায়িত চিকিৎসাকে সমার্থক মনে করেন। সেজন্য এলাকাভিত্তিক পরিপূর্ণ জেনারেল হাসপাতালের বদলে মেডিকেল কলেজ দাবি করেন। যার ফলাফল ব্যাঙের ছাতার মতো মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়া আর ব্যবসায়ী ও আমলাদের অর্থ অর্জনের এক অবারিত দ্বার খোলা; যাতে কিছু অগ্রজ স্বার্থপর মেডিকেল পেশাজীবীগণ নিজেদের স্বার্থও সিদ্ধি করছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে একটা বিশেষায়িত ক্যান্সার ইউনিট করার জন্য অনুমতি, আদেশ-নির্দেশনা ও বরাদ্দ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কি চেয়েছেন এটাকে বর্তমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই ঠেসে দিতে হবে? প্রশ্ন জাগে, এর যথাযথ সমীক্ষা করা হয়েছে কিনা? একশ শয্যার ইউনিটে ইন- পেশেন্ট, আউট পেশেন্ট, টেস্ট, ফলোআপ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কিছুর জন্য কতজন রোগী আসবে, কতজন সাথী আসবে, কতটা প্রাইভেট আর পাবলিক যানবাহন আসবে, পার্কিং ড্রপ আর পিকআপ স্থান কোথায় হবে? যারা এসব না ভেবে নিজেদের ইচ্ছা যেনোতেনো উপায়ে চাপাতে চাচ্ছেন তাদের কাছে আমার নিবেদন- হাসপাতালের সিঁড়ি আর গোল চত্বরের নিকট প্রবেশ নির্গমন স্থানটা দেখেন। ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়ি আর অবাঞ্চিত ভিড়। একশ শয্যার ইউনিট বস্তিতে পরিণত হওয়া এই শিক্ষাঙ্গন আর শিক্ষা-প্রশিক্ষণ হাসপাতালকে ঐতিহাসিক গেটো বা গুলাগে পরিণত হবে। এ ব্যাপারে পরিবেশবিদগণের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়নি।
আরেকটা বিষয় ভুললে চলবে না, ক্যান্সার চিকিৎসা কিন্তু মাল্টিডিসিপ্লিনারি। জেনারেল অনকোলজি, ডায়াগনস্টিক অনকোলজি, মেডিকেল অনকোলজি, সার্জিকেল অনকোলজি, রেডিয়েশন অনকোলজি এবং জেনেটিক অনকোলজি। এ ব্যাপারগুলো কি চিন্তা করে প্ল্যানে রাখা হয়েছে, না গ-ির বাইরে কোন চিন্তা করা হয়নি? এর জন্য ভবিষ্যতে প্রয়োজন হবে পরিবর্ধন আর পরিমার্জনের জন্য খোলা জমির সুযোগ সুবিধা।
চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা জনবসতি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং লোকালয়ে রেডিয়েশন লিকেজ যদি হয় তার কোন ভাবনা কি আছে? আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সেফটি সিকিউরিটিতে আমরা সবসময়ই উদাসীন।
মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের সমন্বিত ট্রেইলিং প্রতিষ্ঠান মেডিকেল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের জন্য। অতএব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট তথা পরিচালককে কখনই ভুললে চলবে না হাসপাতালের সবকিছুতেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের। তাই মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এবং একাডেমিক কাউন্সিলের সাথে পরিপূরক হয়ে চলতে হবে। খবর দেখে আমার মনে হয় সেখানে গুরুতর ব্যত্যয় হচ্ছে যা শিক্ষা, বিজ্ঞান, পেশা, জাতি ও দেশ- কারো জন্য মঙ্গল নয়।
একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা গোল্ডেন জুবিলি পার হয়ে এসেছে। যার সবকিছুই অনেক আবেগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অতীত ও বর্তমানের আত্মা। এগুলো শুধুমাত্র ভবন না। এর সাথে মিশে আছে আনন্দ বেদনার উচ্ছ্বাস আর বিরহ। যাদের ঐতিহ্য নেই তারা এটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না, যেমন আটলান্টিকের এপার-ওপার।
সবদিক সমীক্ষা আর পর্যবেক্ষণ করে নিষ্পত্তিমূলক এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহার ক্যান্সার ইউনিট রোগ, রোগী, চিকিৎসা, চিকিৎসক আর জনগণের সবার কল্যাণে অন্য কোন সুবিধাজনক স্থানে আগামীর সকল সম্ভাবনার দ্বার খোলা রেখে স্থাপন করা হোক।
চট্টগ্রামের জনগণ ও নেতৃবৃন্দ এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সকল প্রাক্তনীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান- জাতির পিতার উপস্থিতিতে পথচলা শুরুর ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বস্তিতে রূপান্তর করার যে প্রচেষ্টা তা প্রতিহত করি।
লেখকঃ প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট