চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

জোয়ারের পানি- জলজট: অধিকাংশ বাড়ির নিচতলা পরিত্যক্ত

তাসনীম হাসান

৪ নভেম্বর, ২০২০ | ২:৩১ অপরাহ্ণ

আগ্রাবাদ থেকে এক্সেস রোড ধরে পথ যতই সামনে এগিয়েছে ততই যেন সুন্দর। প্রায় চার ফুট উঁচু করে তৈরি করা সড়কটিতে এখন আর নেই খানাখন্দের যন্ত্রণা। প্রশস্ত হওয়ায় যানজটের ভোগান্তিও উধাও। সবমিলিয়ে নির্বিঘ্নে যাত্রা। তবে সড়কের দুই পাশের গলিগুলোতে নামলেই অন্য চিত্র। জোয়ার আর বৃষ্টির পানির ধকল সইতে সইতে সেখানকার ভবনগুলোর নিচতলা হয়ে পড়েছে পরিত্যক্ত। এ যেন আলোর পাশে অন্ধকার। শুধু এই সড়কের আশপাশে নয়- উত্তর আগ্রাবাদ, দক্ষিণ আগ্রাবাদ ও দক্ষিণ কাট্টলি মূলত এই তিন ওয়ার্ডে পানির কারণে ভবনের নিচতলা পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। এই তিন ওয়ার্ডে সরকারি ও বেসরকারি হোল্ডিং আছে ১৯ হাজার ১৭৮টি। এর মধ্যে হাজারো ভবনের নিচতলায় থাকা যায় না। কয়েকবছর ধরে এ হার বেড়েই চলছে।

পরিবেশ ও নগর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে দুই ধরণের বিশ্লেষণ পাওয়া গেছে। তাঁরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। আর কমছে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা। চট্টগ্রাম শহরের অনেক এলাকা এই প্রভাবের শিকার হচ্ছে। আবার এর পাশাপাশি তাঁরা অপরিকল্পিত নগরায়নকেও দুষছেন। জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু সড়ক উঁচু করে ফেলায় আশপাশের এলাকা নিচু হয়ে গেছে। জোয়ার ও বৃষ্টি হলেই এসব এলাকায় জমে যাওয়া পানি বের হতে পারে না।

সরেজমিন

সম্প্রতি এক বিকেলে হলিশহর এল ব্লকের ১ নম্বর সড়কে ঢুকতেই দেখা যায় একটি বহুতল ভবনের নিরাপত্তারক্ষী নিচতলায় জমে থাকা পানি ঝাঁটা দিয়ে নালায় বের করে দিচ্ছিলেন। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘জোয়ার এলেই  পানি ঢুকে যায় ভবনে। সেজন্য নিচতলায় থাকা যায় না।’

এরপর গুলবাগ আবাসিক এলাকা ধরে একটু হাঁটতেই হাতের বাম পাশে হামিং বার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। আগে এই স্কুলের কার্যক্রম নিচতলায় ছিল। কিন্তু পানির জন্য এখন দ্বিতীয় তলায় স্থানান্তরিত হয়েছে স্কুলের কার্যক্রম। স্কুলের সামনেই পাওয়া গেল একটি ভবনের মালিক সাজ্জাদ হোসেনকে। তিনি বলেন, নিচতলায় ভাড়া দিতে না পারায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া উত্তর আগ্রাবাদ ও দক্ষিণ কাট্টলি ওয়ার্ডে পড়া অন্তত ১০টি আবাসিক এলাকারও একই চিত্র।

অন্যদিকে দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে জোয়ার এলেই মা ও শিশু হাসপাতালসহ আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকার প্রায় সব ভবনেই নিচতলায় পানি জমে যায়। এসব এলাকায় পানি থেকে বাঁচতে প্রায় সব ভবন ও দোকানের সামনে দুই থেকে তিন হাত উঁচু দেয়াল তোলা হয়েছে।

গৃহকর দিয়ে যান

নিচতলা পরিত্যক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও উত্তর এবং দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের ১৭ শতাংশ হারেই গৃহকর দিতে হয়। তবে দক্ষিণ কাট্টলির বাসিন্দারা ১৪ শতাংশ হারে গৃহকর দেন। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তিন ওয়ার্ড থেকে ৮ কোটি ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ৭৩৯ টাকা গৃহকর আদায় করেছে সিটি করপোরেশন। গৃহকর নিয়ে ক্ষোভও আছে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের মধ্যে। পানি উঠার কথা জানিয়ে তাঁরা গৃহকর মওকূফের দাবিও করেন। কিন্তু দাবির বিপরীতে সেভাবে সাড়া পান না। তাঁদেরই একজন মুহুরিপাড়ার তৈয়ব হোসেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগেই আমাদের চেনেন সবাই। বাকি সময় আমাদের খবর কেউ নেয় না। সড়ক উঁচু করার বিষয়টি অন্তত ১০ বছর আগে পরিকল্পনায় থাকলে আমরা সেভাবে ভবন নির্মাণ করতাম। এখন কি ভবন ভেঙে নতুন করে গড়ার সেই পরিস্থিতি আছে?’

উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক পূর্বকোণকে বলেন, অনেক ভবনের নিচতলা পরিত্যক্ত হয়েছে তা ঠিক। তবে মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে সড়ক উঁচু করা হয়েছে। কিন্তু নালা তো আর ভবনের চেয়ে উঁচু করা হয়নি। ভবনের সঙ্গে নালার সংযোগ ঘটার পথ যদি পরিস্কার রাখা হয় নিচতলায় পানি জমে থাকার বিষয়টি ঘটত না।’

নগর পরিকল্পনাবিদ জেরিনা হোসেন নিজেও শিকার। জলাবদ্ধতার কারণে নিচতলা পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়েছে নিজস্ব বাড়িটি। প্রতিদিন পানি উঠায় আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকার সেই বাড়ি ছেড়ে তিনি এখন পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় উঠেছেন। জেরিনা হোসেন পূর্বকোণকে বলেন, জলবায়ুর প্রভাব তো আছেই। তবে পরিকল্পিত ও টেকসই নগরায়নের চিন্তা থেকে নগর পরিচালনার যে চিন্তা তা এখানে হচ্ছে না। এর বাইরে নালা দখল,  পাহাড়কাটা দায়ী। সব মিলিয়েই তো নগর। একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে আরেকটি প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট