চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গা নামে শহর, বাস্তবে বঞ্চনা

তাসনীম হাসান

২৮ অক্টোবর, ২০২০ | ১২:০৭ অপরাহ্ণ

শহরের মধ্যে গ্রাম। এই বাক্যটি কেউ মুখে আনলেই সবার চোখে ভাসে দুটি ওয়ার্ডের ছবি। সেই দুটি ওয়ার্ড হলো উত্তর পতেঙ্গা ও দক্ষিণ পতেঙ্গা। শহরের মধ্যে অবস্থান করলেও নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত এই দুই এলাকার মানুষ যেন আক্ষরিক অর্থেই গ্রামে বাস করছেন। দ্ইু ওয়ার্ডের সবখানে নেই আর নেই হাহাকার।

এই দুই ওয়ার্ডে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই বললেই চলে। প্রয়োজনমতো ডাস্টবিনও নেই। ওয়ার্ড দুটির অলি-গলির সড়কগুলোর অবস্থাও ভালো না। অকেজো হয়ে পড়ায় সড়কবাতি আলো দেয় না অনেক জায়গায়। মশক নিধন কার্যক্রম না থাকায় দিন-রাত মশার উৎপাতে থাকেন বাসিন্দারা।
সুযোগ-সুবিধা থেকে বহুদূরে থাকলেও এই দুই ওয়ার্ডের মানুষ অন্যান্য ওয়ার্ডের মতোই গৃহকর দিয়ে আসছেন। তাই এলাকাবাসীর প্রশ্ন-আর কতদিন তাঁদের গ্রামের চোখে দেখা হবে?

যেসব সেবা প্রাপ্য : আইন অনুযায়ী নালা-নর্দমা সংষ্কার, পরিচ্ছন্নতা এবং শহর আলোকিত রাখা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অন্যতম দায়িত্ব। এসব কাজ করতে সেবা সংস্থাটি বাধ্যও। কিন্তু প্রধান তিনটি সেবা কার্যক্রম থেকেই বঞ্চিত এই দুই এলাকার মানুষ। এর বাইরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, লেক, খেলার মাঠ ও পার্ক উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যাপ্ত বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষার প্রসার, দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া নগরবাসীর অর্থনৈতিক এবং জীবনমানের উন্নয়নসহ নানা সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা নগরের প্রধান সেবা সংস্থাটির দায়িত্ব। তা তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখও করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সেবাই সেভাবে পাচ্ছেন না দুই ওয়ার্ডবাসী।

গৃহকর আদায়ের চিত্র

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, নগরে সরকারি ও বেসরকারি হোল্ডিং আছে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৪০৫টি। এর মধ্যে উত্তর পতেঙ্গায় মোট হোল্ডিংয়ের সংখ্যা ৫ হাজার ৪২৮টি। এই হোল্ডিংয়ের মধ্যে বেসরকারি ৫ হাজার ৩৯০টি আর সরকারি ৩৮টি। দক্ষিণ পতেঙ্গায় হোল্ডিং আছে ৪ হাজার ১৮৩টি। এর মধ্যে সরকারি হোল্ডিং ৩৬ আর বেসরকারি হোল্ডিং ৪ হাজার ১৪৭টি।

সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪১টি ওয়ার্ড থেকে ১৩৭ কোটি ৪৬ লাখ ২২ হাজার ৭৩২টাকা গৃহকর আদায় করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ড এলাকা থেকে ১৪ শতাংশ হারে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গৃহকর আদায় হয়েছে ২ কোটি ৩১ লাখ ১ হাজার ১৪৪টাকা। একই হারে দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড থেকে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে গৃহকর আদায় হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৩১৩ টাকা।
নেই আর নেই

দুই ওয়ার্ডের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন চিকিৎসাসেবা নিয়ে। চকবাজার থেকে জিইসি মোড়-প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অন্তত ২০টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু পতেঙ্গার দুই বিস্তীর্ণ ওয়ার্ডের প্রায় ১০ লাখ মানুষের জন্য নেই কোনো হাসপাতাল। তাই গুরুতর আহত কিংবা অসুস্থ রোগীকে নিয়ে স্বজনদের প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা জিইসিকেন্দ্রিক হাসপাতালগুলোতে ছুটতে হয়। কিন্তু দীর্ঘ যানজট উপেক্ষা করে হাপসাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেকেই পথে মারা যান।

সড়কবাতি না থাকায় রাতভর সিমেন্ট ক্রসিং থেকে কাটগড় পর্যন্ত সড়ক অন্ধকারে থাকে। এর ফলে রাতে এই এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। অথচ সড়কবাতির জন্য ৩ শতাংশ হারে গৃহকর দিয়ে আসছে এলাকাবাসী।

চট্টগ্রামের একটা আঞ্চলিক পত্রিকায় সহসম্পাদক হিসাবে দায়িত্বে আছেন কাটগড় এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সাহেদ। অফিস শেষে তাঁর বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১টা, দেড়টা বেজে যায়। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘অন্ধকারের কারণে রাতে ওই এলাকা পার হওয়ার সময় আতঙ্কে থাকি। মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে-এই বুঝি ছিনতাইকারী এসে গাড়ি আটকে সব কেড়ে নেবে।’

দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড ছাড়া নগরের ৪০টি ওয়ার্ডে নিজস্ব কর্মীর মাধ্যমে বাসাবাড়ি থেকে সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহ করার (ডোর টু ডোর) কথা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন দাবি করলেও এই দুটি ওয়ার্ডে সেই কার্যক্রম সেভাবে চালু নেই। এর সঙ্গে চাহিদামতো ডাস্টবিন না থাকায় ময়লা-আবর্জনা নিয়ে দুর্ভোগে পড়তে হয় বাসিন্দাদের। অথচ পরিচ্ছন্নতার জন্য ৪ শতাংশ হারে গৃহকর দিতে হয় তাঁদের। ভালো মানের এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংকট থাকায় শিক্ষাদীক্ষায়ও পিছিয়ে পড়ছে দুই ওয়ার্ডের শিক্ষার্থীরা।

যে কোনো নির্বাচনের আগেই জনপ্রতিনিধিরা দুই ওয়ার্ডের মানুষের সামনে সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হন। কিন্তু নির্বাচন শেষ, সব যেন শেষ।
তাই দক্ষিণ পতেঙ্গার বিজয়নগর এলাকার বাসিন্দা রফিকুল হকের কন্ঠে ক্ষোভ ঝরে। জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন ছুড়েন এই বলে, ‘কর দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু কোনো নাগরিক সুবিধাই পাই না। পতেঙ্গাকে ঘিরে অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবুও আমাদের জীবনযাত্রায় কোনো পরিবর্তন নেই। আর কতদিন আমাদের গ্রামের চোখে দেখবেন?’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট