চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

অভাবের তাড়নায় ওরা নির্মাণ শ্রমিক

মরিয়ম জাহান মুন্নী

২৭ অক্টোবর, ২০২০ | ২:৩৭ অপরাহ্ণ

লোহার হাঁতুড়ি দিয়ে একের পর এক ইট ভেঙে যাচ্ছেন ৫৫ বছর বয়সী ফাইজু বেগম, মাঝ বয়সী আছিয়া খাতুন ও লায়লা বেগম। এ বয়সেও ক্লান্তিহীনভাবে মনযোগ দিয়ে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা। তাদেরও যেন কোনো দিকে তাকানোর সময় নেই। সংসারে অভাবের কারণে কেউ ১০ বছর, কেউ ৩ বছর আগেই ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন। শুধু ইট ভাঙাই নয়, বহুতল ভবন নির্মাণের ছাদ ঢালাইয়ের কাজও করেন তারা। পরিবারকে সচ্ছল করার জন্য পুরুষদের পাশাপাশি এই ভারী কাজ এখন নারীরাও করছেন।

এবিষয় মানবাধিকার ও সমাজ কর্মী জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, নারীরা কর্মস্থলে পুরুষের সমপরিমাণ শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। কাজের ক্ষেত্রে যে কেউই কম নয় তার প্রমাণ মেলে কোনো ভবন নির্মাণ কাজে ইটবোঝাই ঝুড়ি মাথায় নিয়ে নারীদের কাজ করতে দেখলে। ইট ভাঙতেও দেখা যায় তাদের। কিন্তু এ নারীরা একজন পুরুষের মত শ্রমসময় ও সমান মজুরি পাচ্ছে না। নির্মাণকাজে অবদান রাখা এসব নারীদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব গল্প। কেউ কাজ করে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে, আবার কারও কাজের পেছনে রয়েছে করুণ কোনো গল্প। পরিবারকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করতে কিংবা অসুস্থ স্বামীর পাশে দাঁড়াতে দিন রাত কাজ করেন নারীরা। হয়ত পরিবারের একমাত্র রোজগারি ব্যক্তিটিই এখন সেই নারী। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় আমাদের দেশে নারীরা এখনো অবহেলিত। কাজের ন্যায্য মূল্য পায় না কর্মক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। গত নভেম্বরে জেনেভাভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ‘বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৪৫টি দেশে নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম। অগ্রগতির এই হার অব্যাহত থাকলে নারী-পুরুষের সমতা আসতে ১১৮ বছর লাগবে।

আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলম বলেন, পুরুষ প্রধান এই সমাজে নারীদের শ্রমমূল্য ও সুবিধায় বৈষম্যের শিকার নারীরা। সবচেয়ে সস্তা শ্রম পাওয়া যায় বাংলাদেশে। আমাদের দেশের জনগণের একটি ধারণা নারীরা পুরুষদের তুলনায় অধিক কাজ করতে সক্ষম নয়। তাই শ্রম মূল্যও দেওয়া হয় পুরুষদের তুলনায় কম। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর পুরুষদের সাথে এই বৈষম্যের শিকার হন নারীরা।

একজন পুরুষ শ্রমিকদের নির্মাণকাজে দৈনিক ৩০০-৫০০ টাকা দেওয়া হলেও সেখানে একজন নারীকে দেওয়া হয় কেবল মাত্র ২০০-৩০০। কিন্তু কেন এই বৈষম্য? নারীদের শ্রমঘন্টাও পুরুষের চেয়ে বেশি। অল্প টাকায় অনেক বেশি খাটানো হয় নারীদের। এর কারণ শ্রমজীবী এ নারীরা আওয়াজ তুলতে পারে না। এ নারীদের জন্য আমাদের সমাজের নারীবাদি সংঘঠনগুলোকে এগিয়ে আসা দরকার। শুধু লেখালেখির মাধ্যমেই নয়, সবগুলো নারীবাদী সংঘঠনকে একত্রিত হয়ে শ্রমজীবী নারীদের পুরুষের সমান শ্রম ঘণ্টা ও মজুরি আদায়ের বিষয় শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এখন আর পিছিয়ে থাকার সময় নেই। নারীরাও একজন পুরুষের সমান কাজ করছে। তাই প্রতিটি মালিক বা কোন সংস্থার আওতায় কাজ করা নারীদের সঠিক বেতন, শ্রমঘন্ট ও নিরাপত্তা প্রধান করা তাদের একান্তা দায়িত্ব। কোনো দুর্ঘটনায় নারীদের আর্থিক সহায়তা করার ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত করাও দরকার।

ফাইজু বেগমের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি বরিশাল ভোলায়। ১৫ বছর আগে স্বামীর সাথে চার সন্তানকে নিয়ে চট্টগ্রামে আসি জীবিকার তাগিদে। আমার স্বামীও ভবন নির্মাণের কাজ করতো। সংসারে অভাবের কারণে তার সাথেই আমার প্রথম কাজে আসা। কিন্তু তিনি নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে পঙ্গু হয়ে ঘরে আছে ৫ বছর। সেই থেকে আমি এ কাজ করে সংসারের হাল ধরি। এখন এক মেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করছে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট