আগে আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করতাম। সেদিনও ভোরে ঘুম থেকে উঠে ভাত খাই। আরেকটা বাটিতে দুপুরের খাবার নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হব এমন সময় আমার দুই বছরের মেয়েটা কান্না শুরু করে। তাই তাকে শান্ত করতে কিছুক্ষণ তার সাথে খেলাও করি। কিন্তু মেয়ের কান্না থামে না। এদিকে আমার কাজের সময় হয়ে যাচ্ছে। তাই আর অপেক্ষা না করেই মেয়েকে রেখে বেরিয়ে পড়ি। বায়েজিদ বাইপাশ সড়ক পার হতেই একটি রাঙামাটিগামী একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে পা চাপা দেয়। এরপরে কিছু মানুষ আমাকে চট্টগ্রাম হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখনি আমার একটা পায়ের হাঁটু পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়। সেই দিন থেকেই আমার জীবনে দুঃখ নেমে আসে। দুর্ঘটনার পাঁচমাসের মাথায় আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তার সাথে আমার ছয় বছরের সংসার জীবন মাত্র একটি পা হারানোর কারণে পাঁচমাসে শেষ হয়ে যায়।
আমার গ্রামের বাড়ি চকরিয়া হারবাং। আমরা চার ভাই। সবাই বিয়ে করে যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তবুও সেজোভাই অসুস্থ অবস্থায় আমাকে আটমাস বসিয়ে খাইয়েছে। তারও সংসারে অভাব। পরে আমি নিজেই তার সহযোগিতা নিয়ে আবার শহরে চলে আসি। আমিতো আর কোনো কাজ করতে পারবো না। তাই পেটের দায়ে ভিক্ষা করতে পথে নামি। এভাবেই এখন জীবন চলছে। তবে মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছি। সে তার সেজো চাচার সাথেই গ্রামে থাকে। আমার মেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। এ একটি সড়ক দুর্ঘটনা আমার সাজানো জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। ছলছল চোখে কথাগুলো বলছিলেন মিলন মিয়া।
১৭ বছর আগে এমন একটি সড়ক দুর্ঘটনায় নিজের এক পা ও আরেক পায়ের তিন আঙ্গুল হারান তিনি। তার এক বছর পর থেকেই নগরীর বিভিন্ন সড়কের পাশে বস্তা পেতে ভিক্ষা করতে দেখা যায় তাঁকে। প্রতি দিনের মত গতকালও নগরীর চকবাজার মতি টাওয়ারের সামনে বসে ভিক্ষা করছেন। তখনি তাঁর সাথে আলাপকালে জানা যায় জীবনের এ কথাগুলো।
সড়ক দুর্ঘটনা শুধু মিলন মিয়ার সাজানো সংসারই নয়, তছনছ করেছে মো. মান্নানের জীবনও । দীর্ঘ ১১ বছরের প্রবাস জীবন শেষেই দেশে ফিরে আসেন মান্নান। তিনি বলেন, মাত্র ১৪ মাসের মাথায় সড়ক দুর্ঘটনায় আমার এক পা হারাই। আমার বাড়ি কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। সেই দিন ছোট মেয়েকে দেখতে যাচ্ছি তার শশুরবাড়ি। যাওয়ার পথে বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হতেই একটি লরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমাদের কয়েক জনকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যায়। আমিসহ আরো পাঁচজন গুরুতর আহত হই। এরপরে আমি বাকিদের কথা বলতে পারবো না। কিন্তু আমি আমার এক পা হারাই। এর তিনবছর পরে স্ত্রীও মারা যায়। নিজে বাঁচার তাগিদে এখন ভিক্ষা করছি। থাকি গরীবুল্লাহ শাহ মাজারের বারান্দায়।
আমারতো আর কেউ নেই। তবে নিজের আয়ের টাকা দিয়ে তিন মেয়ের ঘরে তিন নাতীকে পড়ালেখা করাচ্ছি। মেজো মেয়ের স্বামী মারা যায়। তার সংসারও আমিই চালাই।
পূর্বকোণ/এএ