চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

নীরবে কাঁদেন পায়েলের বাবা-মা

নীরবে কাঁদেন পায়েলের বাবা-মা

তাসনীম হাসান

২০ অক্টোবর, ২০২০ | ৪:১৮ অপরাহ্ণ

দুপুরের কড়া রোদ তখন একেবারে মাথার ওপর। এর মধ্যেই ধীর গতিতে কবরস্থানের দিকে এগিয়ে গেলেন গোলাম মাওলা। গিয়ে দাঁড়ালেন ঠিক ছেলে যেখানে ঘুমিয়ে আছে সেই কবরের সামনে। এরপর গুনগুন করে পড়তে থাকলেন পবিত্র কোরআনের বাণী। শেষে দু’হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে দীর্ঘ প্রার্থনা। চোখ তখন ছলছল করছে জলে।

এই গোলাম মাওলা হলেন নির্মমভাবে হত্যার শিকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র সাইদুর রহমান পায়েলের বাবা। গতকাল সোমবার দুপুরে হালিশহরের বি-ব্লকের কবরস্থানে এই হতভাগা বাবাকে পাওয়া গেল ঠিক এভাবেই। অবশ্য ছেলের কবরের কাছে যাওয়া গোলাম মাওলার কাছে নতুন নয়। ঝড় কিংবা রোদ অথবা জলাবদ্ধতা-যাই থাকুক ছেলেকে ‘দেখতে যাওয়াই’ তাঁর প্রতিদিনের অনিবার্য সূচি।

ছেলের কাছ থেকে ফেরার পথে কথা হয় গোলাম মাওলার সঙ্গে। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘বাসায় মন মানে না। মনে হয় ছেলে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তাই ছুটে আসি প্রতিদিন।’ বলতে বলতে গলা শুকিয়ে আসে গোলাম মাওলার। ছেলে শোকে ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে উঠে শোকাতুর বাবার কণ্ঠ।

২০১৮ সালের ২১ জুলাই হানিফ এন্টারপ্রাইজের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন পায়েল। ২৩ জুলাই মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার ভবের চরে পায়েলের লাশ পাওয়া যায়। পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে-পায়েল বাথরুমের কথা বলে মাঝপথে গাড়ি থেকে নামেন। পুনরায় গাড়িতে ওঠার সময় আহত হন তিনি। রক্তাক্ত পায়েলকে হাসপাতালে পাঠানোর পরিবর্তে মুখ থেঁতলে নদীতে ফেলে দেন বাসের কর্মীরা। এ ঘটনায় মামলা করে পায়েলের পরিবার। বহুল আলোচিত মামলাটি রায় ঘোষণার অপেক্ষায় আছে। মামলার তিন আসামিই কারাগারে আছেন।

ভাইবোনদের মধ্যে ছোটজন পায়েল ছিলেন মা-বাবা আর মামাদের কাছের খুব আদরের। তাঁর বাবা গোলাম মাওলা কাতারপ্রবাসী ছিলেন। সেই ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের ওই দেশে যান তিনি। তারপর ২৯ বছর ধরে সে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন গোলাম মাওলা। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই দেশে ফেরেন তিনি। চারমাস দেশে অবস্থানের পর একই বছরের ১৯ নভেম্বর পুনরায় কাতারে ফিরে গিয়েছিলেন চাকরিতে যোগদান করতে। কিন্তু ছেলেকে চিরদিনের জন্য কবরে ঘুমিয়ে দিয়ে যাওয়া বাবা আর সেই চাকরিতে স্থায়ী হতে পারেননি। তাই ৩০ নভেম্বর চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসেন ছেলের কাছে। তারপর থেকে গোলাম মাওলা চট্টগ্রামে আছেন আর ছেলের কবরের কাছে যাননি-এমনটা কোনোদিন হয়নি। আজও নীরবে ডুকরে ডুকরে কাঁদেন পায়েলের বাবা-মা।

বাবা গোলাম মাওলা তবু প্রতিদিন ছেলের কবরের কাছে যেতে পারছেন, কিন্তু মুখ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় ছেলেকে শেষবারের মতো দেখতে না পারার দুঃখ বয়ে নিয়ে চলা মা কোহিনূর বেগম হয়ে পড়েছেন একেবারেই ঘরবন্দী। হালিশহরের আই ব্লকের সেই ঘরের দেয়ালে দেয়ালে মায়ের কান্না-বিষাদ আর দুঃখের কথা যেন ঠোক্কর খায় প্রতিমুহূর্তে।

আগামী ১ নভেম্বর বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। রায়ে ছেলের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে-সে আশায় বুক বেঁধেছেন মা বাবা।

শোকের সাগরে ডুবে থাকা মা-বাবার কাছে এর চেয়ে বড় কোনো চাওয়া নেই আর।

 

 

 

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট