চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পতেঙ্গা-হালিশহর এলাকায় হাসপাতাল নেই, পথেই মৃত্যু

তাসনীম হাসান

১৮ অক্টোবর, ২০২০ | ২:২৭ অপরাহ্ণ

চলতি বছরের প্রথমদিন। নতুন বই আনতে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে ট্রাকের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয় চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রেশমি আক্তার। পতেঙ্গার কাটগড় এলাকার ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে স্বজনেরা ছুটেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। যানজট আর ভাঙা সড়ক উপেক্ষা করে হাসপাতালে পৌঁছতেই কেটে যায় দেড়ঘণ্টা। হাসপাতালে ঢোকার পর চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, অধিক রক্তক্ষরণে মারা গেছে রেশমি।
মেয়ে হারানোর ১০ মাস পরেও রেশমির বাবা মোহাম্মদ শাহানুর আক্তার মনে করেন, দ্রুত চিকিৎসা পেলে তাঁর মেয়ে বেঁচে যেত। গত শুক্রবার যোগাযোগ করা হলে সেই কথা বলেই বিলাপ করে ওঠেন শোকাতুর বাবা। মেয়েকে ঘিরে জমে থাকা পুরোনো স্মৃতিগুলো যেন নতুন করে অসহায় বাবার বুকে ধারালো পিনের মতো বিধছে।
শোক কিছুটা প্রশমিত হতেই শাহানুর বলেন, আশপাশে কোনো হাসপাতাল না থাকায় মেয়েকে নিয়ে যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু দূরত্ব বেশি হওয়ায় ও যানজটের কারণে অনেক সময় লেগে যায়। তিনি চান পতেঙ্গা এলাকায় একটি হাসপাতাল হোক। যাতে আর কেউ তাঁর মতো স্বজন না হারান।
দ্রুত হাসপাতালে নিতে না পারায় স্বজন হারানোর হৃদয়ভাঙার এই দুঃখ শুধু শাহানুরের একার নয়। শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত পাঁচটি ওয়ার্ডের প্রায় ১৯ লাখ মানুষ একটি সরকারি হাসপাতালের অভাবে বহুবছর ধরে ভুগছেন। এর মধ্যে বিশেষ করে ইপিজেড-পতেঙ্গাকেন্দ্রিক তিনটি ওয়ার্ডের মানুষের ভোগান্তি একটু বেশিই। কারণ সেখানে দুটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল থাকায় এলাকাটি এমনিতেই জনাকীর্ণ। এ ছাড়া বন্দর ও বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কারণে এখানকার সড়কগুলো সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকে। এর বাইরে এখন রিং রোড, বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে এসব এলাকাকে ঘিরে। ফলে পতেঙ্গা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অথবা জিইসি মোড়কেন্দ্রিক বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পৌঁছাতে পথে পথে পড়তে হয় তীব্র যানজটে।
সরেজমিন
গত শুক্রবার ও শনিবার ইপিজেড ও পতেঙ্গা এলাকার অন্তত ২০ জন মানুষের সঙ্গে কথা হয় পূর্বকোণের। তাদের অনেকেই হাসপাতালের অভাবে নানা সময়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন।
ইপিজেড এলাকায় পাওয়া গেল পোশাকর্মী সাহেদা বেগমকে। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, সম্প্রতি তাঁর বড় বোন অপরিপক্ক বাচ্চা প্রসব করেন। নবজাতকের শ্বাসকষ্ট থাকায় অক্সিজেন সেবার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু দ্রুত হাসপাতালে যেতে না পারায় পথেই মারা যায় শিশুটি।
কাটগড় এলাকার বাসিন্দা সাহেদ হাসান শোনালেন আরও গভীর কষ্টের কথা। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, এলাকায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু হ্ওয়ার খবর প্রায় সময় কানে আসে। কারণ, আশপাশে হাসপাতাল না থাকায় হঠাৎ প্রসবেদনা উঠলে অনেকেই ঘরে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করেন। আর এতেই তৈরি হয় ঝুঁকি। বিশেষায়িত একটা হাসপাতাল হলে আর এই ভোগান্তি থাকবে না।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণ হালিশহর এলাকায় একটি মাতৃসদন হাসপাতাল থাকলেও সেখানে চিকিৎসাসেবার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। হাসপাতাল না থাকার সুযোগে নগরের এসব প্রত্যন্ত এলাকায় ভুয়া চিকিৎসকদের উৎপাতও আছে। তাঁরা চেম্বার খুলে অপারেশন থেকে অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসাসেবাও দিয়ে আসছে। অসহায় রোগীরা বাধ্য হয়ে তাঁদের দ্বারস্থ হচ্ছেন আর বিপন্ন করে তুলছেন নিজের জীবনকে।
আশার আলো
পতেঙ্গায় একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নির্মাণের দাবিতে অনেকদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে এলাকাবাসী। ২০১৯ সালের ২৫ অক্টোবর কর্ণফুলী ইপিজেড চত্বরে কয়েকশ মানুষ মানববন্ধন করেন। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে ওই এলাকায় মাতৃসদন হাসপাতাল চেয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেককে চিঠি দিয়েছেন সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন।
এই অব্যাহত দাবির মুখে সম্প্রতি পতেঙ্গা-ইপিজেড অঞ্চলে একশ’ শয্যার একটি জেনারেল হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জায়গা নির্বাচনে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে জন্য একটি কমিটি করা হয়। সেই কমিটি দুটি জায়গাও চিহ্নিত করেছে।
তবে হাসপাতালের অভাবে স্বজন হারানো এলাকাবাসী প্রতিশ্রুতি নামক মুখের বুলিতে আর ভরসা করতে চান না। তাঁরা এবার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চান। তবেই তাঁদের স্বজন হারানোর দুঃখে কিছুটা হলেও প্রলেপ পড়বে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট