চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চান্দগাঁওয়ে জোড়া খুন: জবানবন্দিতে যা বলল আসামি ফারুক

চান্দগাঁওয়ে জোড়া খুন: জবানবন্দিতে যা বলল আসামি ফারুক-

নিজস্ব প্রতিবেদক

৪ অক্টোবর, ২০২০ | ৯:২৩ অপরাহ্ণ

নগরীর পুরাতন চান্দগাঁও এলাকায় মা-ছেলের ডাবল মার্ডারের আসামি ফারুক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আজ রবিবার (৪ অক্টোবর) মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে বিকাল তিনটায় এ জবানবন্দি দেয় সে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার (১ অক্টোবর) চট্টগ্রামে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় ফারুক।

জবানবন্দিতে ফারুক বলেন, আমি ২০০৮ সালে চাকরির জন্য দুবাই যাই। পরে আমি ২০১৩ সালে দুবাই হতে দেশে আসার পর ওয়ার্কশপে কাজ করি। এ সময় কসাই পাড়ার ইলিয়াছ (৪৫) নামে একজনের সাথে পরিচয় হয়। সে খারাপ মেয়ের ব্যবসা করত। একদিন ইলিয়াছের বউ আমাকে ফোন করে বলে, “তুই তো বিয়ে-শাদি করস নাই, আমার কাছে একটা মেয়ে আছে, তুই আয়”। আমি তখন ইলিয়াছের ঘরে গেলে তার সূত্রে গুলনাহারের সাথে আমার পরিচয় হয়। গুলনাহার ওই সময় আমার মোবাইল নম্বর নেয়। এরপর থেকে গুলনাহার প্রায় সময় আমাকে ফোন করত। ফোনে কথা বলে জানতে পারি সে বিবাহিত এবং তার দুইটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। সে আমাকে জানায় তার স্বামীর সাথে বর্তমানে তার সম্পর্ক নাই ও তার স্বামী কুমিল্লায় থাকে।

ওই সময় ফুলকলি কবরস্থানের পাশে গুলনাহারের বাসা ছিল। ধীরে ধীরে গুলনাহারের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে গুলনাহার আমাকে বলে সে আমার সাথে থাকতে চায় ও আমি যেন তার জন্য একটা বাসা ভাড়া নিই। পরবর্তীতে আমি ও গুলনাহার নিজেদের স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে শুলকবহর এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিই। ওই বাসায় গুলনাহার বিভিন্ন খারাপ মেয়েকে দিয়ে অবৈধ ব্যবসা করত। এলাকার লোকজন বিষয়টি বুঝতে পারলে আমরা ওই বাসাটা ছেড়ে দিয়ে চান্দগাঁও থানার মৌলভী পুকুর পাড়ে পুনরায় আরেকটি বাসা ভাড়া নিই। ওই বাসায় আমরা প্রায় দুই মাস স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে থাকি। সেখানেও সে মেয়ে দিয়ে অবৈধ ব্যবসা করত। তখন গুলনাহারের ছেলে-মেয়ে ফুলকলির পাশে ভাড়া বাসায় থাকত। এলাকার লোকজন অবৈধ ব্যবসার কথা জেনে যাওয়ায় মৌলভী পুকুর পাড়ের বাসাটিও ছেড়ে দিতে হয়।

এরপর প্রায় ৩ মাস পর্যন্ত আমার সাথে তার দেখা হয়নি। এরপর পুনরায় গুলনাহার আমাকে ফোন দিয়ে যোগাযোগ করলে আমরা আবার এক কিলোমিটার এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিই। পুনরায় আমরা এ বাসাটা ছেড়ে রাহাত্তারপুলে একটি বাসা ভাড়া নিই। সেখানে গুলনাহারের ছেলে-মেয়ে একসাথে থাকত ও মাঝেমধ্যে গুলনাহারের বাবাও আসত। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে গুলনাহার তার স্বামীকে ডির্ভোস দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু গুলনাহার তার স্বামী এর নিকট থেকে এক লাখ টাকা চাইলে সে না দেয়ায় তাদের মধ্যে আর ডিভোর্স হয়নি। সে সময় গুলনাহার ও তার স্বামীর বিষয় নিয়ে একটি সালিশি বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে আমিও ছিলাম। তারপর থেকে আমি ও গুলনাহার একসাথে বসবাস শুরু করি। আমরা ভাইবোনের পরিচয় দিয়ে প্রায় ১৭-১৮টি বাসায় পরিবর্তন করি।

সর্বশেষ আমরা চান্দগাঁও থানার রমজান আলী সেরেস্তার বাড়ির মঈনুদ্দিনের ভাড়া ঘরে বাসা ভাড়া নিই। সবার কাছে তাকে বোন বলে পরিচয় দিতাম। ওই বাসা থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে আমার নিজ বাডড়ি। আমি নিজ বাড়িতে থাকতাম ও মাঝে মাঝে গুলনাহারের ভাড়া বাসায় আসা-যাওয়া করতাম। মঈনুদ্দিনের অপর থেকে আমার সাথে গুলনাহারের প্রায়ই সময় ঝগড়া হত। চলতি বছর কোরবানের ঈদের আগের দিন মত ভ্যানে করে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বি-ব্লকের গেইটের মুখে বিরিয়ানি ও পান-সিগারেট বিক্রি বাজার করে গুলনাহারের বাসায় জিনিসপত্র দিয়ে আসতাম এবং গুলনাহার বিরিয়ানি ও অন্যান্য নাস্তা তৈরি করে দিত এবং আমি তা বিক্রি করতাম। কোরবানের ঈদের পরে আমি সম্ভবত একদিনের জন্য বিরিয়ানি বিক্রি করি। আমি তার বাসায় যেতাম সে রেগে গিয়ে আমাকে প্রায় সময় মারতে আসত ও ভয়ভীতি দেখাত। এসব আমার ভাল লাগত না। আমি ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হয়ে আসতাম। পুনরায় আমার নিজ বাড়িতে ফিরে যেতাম।

ঘটনার আগে আমি গত ২২ আগস্ট সর্বশেষ তার বাসায় যাই। সেদিনেও সে আমার সাথে ঝগড়া করে। আমি তার কাছ থেকে ক্ষমা চাই এবং আর কখনো ঝগড়া করব না বলে তার কাছে শপথ করি। দুদিন পর গত ২৪ আগস্ট আমি সকাল আনুমানিক ৯টার দিকে গুলনাহারের বাসায় যাওয়ার পথে তার সাথে দেখা হলে আমরা দুজনেই একসাথে ভাড়া বাসায় প্রবেশ করি। আমি বাসায় গিয়ে বাথরুমে গেলে সে আবার চিক্কার-চেঁচামেচি শুরু করে। আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে আসলে তার সাথে আমার ঝগড়া শুরু হয়। সে আমাকে নানা অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করে মারতে আসলে আমি তাকে বাধা দিই। এরপর সে কিছু প্লেট দিয়ে আমাকে আঘাত করলে প্লেটগুলো ভেঙ্গে যায়। পরে আমিও তাকে ধাক্কা দিই। তৎক্ষণাৎ সে একটা কাঠের বাটযুক্ত ছুরি দিয়া আমাকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকলে তার কয়েকটা আঘাত আমার হাতের আঙ্গুলে লাগে। পরে আমি তার সাথে ছুরি নিয়ে ধস্তাধস্তিতে করতে থাকলে আমার পিছনে গুলনাহারের ছেলে রিফাত হঠাৎ করে চলে আসলে ছুরিটি রিফাতের গায়ে লাগে। সাথে সাথে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যায় ও তার গলা দিয়া রক্ত বের হতে শুরু করে। আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুরিটি গুলনাহারের হাত হতে কেড়ে নিয়ে গুলনাহারের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকলে সে বাথরুমে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে দেখি মা ও ছেলে দুজনেই রক্তাক্ত অবস্থায় অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। এ অবস্থা দেখে আমিও কিছুক্ষণ সেখানে চুপ করে বসে। থাকি। পরে আমি আমার শরীরের রক্তের দাগ গুলনাহারের ওড়না ও কাপড় দিয়ে মুছে ফেলি। আমি লুঙ্গি দিয়ে শরীর ঢেকে ওই ঘর থেকে বের হয়ে আমার বাড়িতে এসে কাপড়চোপড় পরিবর্তন করে সেগুলো নালায় ফেলে দিই।

সেদিন আমি এলোমেলো ঘোরাঘুরি করে রাতে আমানত শাহ মাজারে চলে যাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি অক্সিজেন মোড় থেকে বাসে চড়ে খাগড়াছড়ি চলে যাই। সেখানে আমি একটি গ্যারেজে কাজ নিই। সেখানে প্রায় মাসখানেক আমি কাজ করার পর ঢাকায় চলে যাই। গত বৃহস্পতিবার (১ অক্টোবর) র‌্যাব আমাকে গ্রেপ্তার করে।

 

 

 

 

পূর্বকোণ/আরআর-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট