চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

চট্টগ্রামে ১৮শ পত্রিকা হকারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি

ইমাম হোসাইন রাজু / সিএনএ হ

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ৪:১৮ অপরাহ্ণ

সংবাদপত্রের হকার মো. সুমন। ছেলে মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে থাকেন নগরীর বায়েজিদ থানাধীন চন্দ্রনগর এলাকায়। পত্রিকা বিক্রি করেন জিইসি-দামপাড়া ও ওয়াসার আশপাশের এলাকায়। গড়ে আড়াইশ’ গ্রাহকের কাছে প্রতিদিন পত্রিকা পৌঁছে দেন তিনি। করোনা শুরু হওয়ার পর যখন সবাই ঘরবন্দী ছিলেন, তখনও এলাকায় ঘুরে ঘুরে নিয়মিত পত্রিকা পৌঁছে দিয়েছেন তিনি।
সুমন জানান, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে গত ৫/৬ মাস ধরে পত্রিকা বিলি করে এলেও করোনা দূরের কথা এখন পর্যন্ত জ্বরেও আক্রান্ত হয়নি তিনি। সুমনের মতো সুস্থ আছেন চট্টগ্রাম নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের ১ হাজার ৮০৬ জন হকার।
শুধু তাই নয়, করোনাকালে সরাসরি পত্রিকা বিক্রি ও সরবরাহের সাথে সক্রিয় ছিলেন এমন কোন হকার- বিক্রেতার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের সংবাদপত্র সমিতি ও এজেন্ট মালিক সমিতির সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলছেন, কাগুজে সংবাদপত্রের সাথে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কোন নজির নেই। এর মাধ্যমে করোনা ছড়ায় না।
করোনায় আক্রান্ত হননি একজন হকারও :
প্রাপ্ত তথ্য মতে, চট্টগ্রাম নগরীর সংবাদপত্র হকার্স সমিতি ও সংবাদপত্র এজেন্টের আওতায় এক হাজার ৮০ জন সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে শুধুমাত্র ১৯ জন সাধারণ জ¦রে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাদের করোনার নমুনা পরীক্ষা করলেও ফলাফল নেগেটিভ পাওয়া গেছে। ১৪ উপজেলায় পত্রিকা বিক্রির সাথে জড়িত ৩১০ জন হকার থাকলেও তাদের কেউই অসুস্থতায় ভোগেননি করোনাকালে। একই অবস্থা রাঙামাটি জেলার ২৩ জনের, খাগড়াছড়ি জেলার ১৭ জনের, বান্দরবান জেলার ২৩ জনের। তবে কক্সবাজার জেলায় থাকা ৭৫ জনের মধ্যে ৩ জন হকার জ্বরে আক্রান্ত হলেও তাদের কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফলাফল ছিল নেগেটিভ।
চট্টগ্রাম সংবাদপত্র হকার্স সমিতির সভাপতি মো. ইউসুফ বলেন, ‘করোনাকালে আমাদের সকল হকার সক্রিয়ভাবে পত্রিকা সরবরাহে নিয়োজিত ছিলেন। তবে তাদের কেউই করোনায় আক্রান্ত হননি। শুধুমাত্র ১৯ জন সামান্য জ্বরে ভুগছিলেন, তবে তাদের কোভিড পরীক্ষা করা হলে ফলাফল নেগেটিভ আসে। সবাই এখন পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে কাগজ বা নিউজ পেপার থেকে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে, এমন তথ্য ছড়িয়ে পড়ায় বিভ্রান্তির শিকার হয়ে অনেকে বাসায় বা অফিসে পত্রিকা পড়া বন্ধ রেখেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এমন অনুমানের কোন বৈজ্ঞানিক কিংবা গবেষণালব্ধ ভিত্তি পাওয়া যায়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অভিমত:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), মহামারী ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মৌলিক গবেষণা প্রকাশ করা যুক্তরাজ্যের ‘জার্নাল অব হসপিটাল ইনফেকশন’, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজ এবং যুক্তরাজ্যের জন ইনস সেন্টার (উদ্ভিদ ও অণুজীব নিয়ে গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান) বলছে, ‘ছাপা পত্রিকায় করোনাভাইরাস ছড়ায়’- এ রকম একটিও নজির পৃথিবীর কোথাও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সংবাদপত্রকে নিরাপদ উল্লেখ করে বলেছে, সংবাদপত্র উৎপাদনের বিষয়টি এতটাই স্বয়ংক্রিয় যে তাতে সংক্রমণের কোনো ঝুঁকি নেই। কেউ আক্রান্ত হয়েছেন এমন প্রমাণও পাওয়া যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রসিদ্ধ মেডিকেল জার্নাল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে একটি গবেষণার ফলাফল ছাপা হয়। তাতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, সিডিসি, ইউসিএলএ এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ফল অনুযায়ী যেসব জিনিসে ভাইরাসটির টিকে থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম, নিউজপ্রিন্ট তার মধ্যে অন্যতম। অর্থাৎ ছাপা পত্রিকায় ব্যবহৃত কাগজ (নিউজপ্রিন্ট) কার্ডবোর্ডের চেয়ে অনেক বেশি ছিদ্রযুক্ত। এবং অনেকটাই অমসৃণ বলেই তাতে ভাইরাস যুক্ত হতে পারে না।
জন ইনস সেন্টারের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ জর্জ লোমনোসফ সম্প্রতি বিবিসি রেডিও স্কটল্যান্ড এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পত্রিকা যেভাবে ছাপা হয় আর যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়, তাতে পত্রিকা এমনিতেই অনেকটা জীবাণুমুক্ত থাকে। এ কারণেই ভাজা খাবার নিউজপ্রিন্টে রেখে খাওয়া হয়। আর কালি ও কাগজ একে অনেকটা জীবাণুমুক্ত করে দেয়।
এ বিশেষজ্ঞের কথার সূত্র ধরে পত্রিকায় ব্যবহৃত কাগজ ও কালি প্রস্তুতকারকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নিউজপ্রিন্ট ও কালি তৈরিতে যে ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তাতে কোন জীবাণু বা ভাইরাস থাকার শঙ্কা নেই। এরমধ্যে পত্রিকায় ব্যবহৃত বেশিরভাগ নিউজপ্রিন্ট তৈরি হয়ে থাকে পুরাতন বা ব্যবহৃত কাগজ দিয়েই। এসব কাগজ থেকে নতুন করে নিউজপ্রিন্ট তৈরি করতে গেলে বিভিন্ন ধাপে ব্যবহার করা হয় নানা কেমিক্যাল। তারমধ্যে ডেক্সট্রিন, অক্সিডাইজ স্টার্চ, কাট্রিকপাস, সোডিয়াম নিনিকেট, হাইড্রোজেন অক্সাইড ইত্যাদি।
হাক্কানি পাল্স এন্ড পেপার্স মিলস’র কোম্পানি সেক্রেটারি এন্ড ম্যানেজার মো. মুসা বলেন, ‘পত্রিকায় ব্যবহৃত কাগজগুলো হচ্ছে নিউজপ্রিন্ট। যা উৎপাদন হয়ে থাকে বেশিরভাগই ব্যবহৃত কাগজ থেকে। নতুন করে উৎপাদন করতে যে কেমিক্যাল ব্যবহার হয়, সেটা এক ধরনের সাবানের মতোই। অর্থাৎ কাগজগুলো থেকে সকল ধরনের জীবাণু মুক্ত করতেই এসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। এতে শতভাগ জীবাণুমুক্ত হয়ে যায়। কেমিক্যালগুলো ব্যবহারের ফলে কোন ধরনের ভাইরাস থাকবে না। আমরা যে টিস্যু পেপার ব্যবহার করে থাকি। সেই ক্যাটাগরিতেই এসব নিউজ প্রিন্ট তৈরি হয়ে থাকে। সুতরাং নিউজ পেপারে ভাইরাস থাকার কোন প্রশ্নই আসে না।’
দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় এবং প্রিন্টিংয়ে ব্যবহৃত কালি সাপ্লাইয়ার জিসান ইন্ট্রারন্যাশনাল এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেডের ম্যানেজার (সেল্স এন্ড বিজনেস) আরিফুর রহমান রাজু বলেন, ‘কাগজে ব্যবহৃত কালিগুলোতে একধরনের তেল ব্যবহার হয়, যা জীবাণুকে শতভাগ ধ্বংস করে। ওই তেলকে বলা হয় মিনারেল অয়েল। যা মানবদেহে কোন ক্ষতিকর নয়।’
হকারগণও মানছেন স্বাস্থ্যবিধি
কারও কারও ধারণা কাগজের মাধ্যমে না ছড়ালেও হকারের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। এমন উত্তর খুঁজতে গিয়ে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় করোনাকালে সক্রিয়ভাবে পত্রিকা সরবরাহকারী বা হকারদের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয়। তাতে দেখা যায়, এ পাঁচ জেলায় সক্রিয় ১ হাজার ৮০৬ জন হকারের মধ্যে কেউই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি। তবে মাত্র ২২ জন হকার জ্বরে ভুগেছিলেন। যদিও তাদের কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ ছিল।
হকারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করেই তারা মানুষের বাসা বাড়িতে নিয়মিতভাবে পত্রিকা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। নিয়মিতই তারা হ্যান্ড স্যানিটাইজার করেছেন।’
শুধু তাই নয়, পত্রিকার প্রতিষ্ঠান থেকে পরিবহন ও বিতরণের সর্ব পর্যায়ে ভাইরাস সংক্রমণ রোধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। এরমধ্যে সংবাদপত্র প্রকাশ থেকে তা গ্রাহকের বাসায় যাওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার জোর দেয়া হয়েছে।
সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সুনির্দিষ্টভাবে এ বিষয়ে কাজ করে গেছেন। পত্রিকার এজেন্ট ও হকাররা যাতে করোনার সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে পারেন সেজন্য তাদের মাঝে মাস্ক ও গ্লাভস এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণের অভিমত:
দেশের প্রথম ফিল্ড হাসপাতালের উদ্যোক্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কাগজের বা সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায়, এমন নজির কোথাও নেই। যে বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও পূর্বে জানিয়েছেন। এটি মূলতঃ আমাদের নিজেদের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা। তাছাড়া করোনার শুরুর পর থেকে মানুষের মধ্যে একটি আতঙ্ক ছিল বলেই এমন ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। তবে এর ভিত্তি নেই। এটা পরিষ্কার যে নিউজ প্রিন্টের মাধ্যমে কোন ধরনের ভাইরাস ছড়ায় না।’
এ বিশেষজ্ঞের মতো একই মত দিলেন জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটির আহবায়ক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পত্রিকার মাধ্যমে কোন ধরনের জীবাণু ছড়ায় না। তবে সন্দেহ থাকতে পারে, হকারের সংস্পর্শে এলে করোনা ছড়াতে পারে কিনা। তাহলে অবশ্যই পত্রিকা পড়া শেষে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিলেই হয়। তিনি বলেন, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানলে কোন ধরনের জীবাণুই আমাদের আঘাত করতে পারবে না।’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট