চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ট্যাক্স-ভ্যাটে নাকাল জাহাজভাঙা শিল্প

ট্যাক্স-ভ্যাটে নাকাল জাহাজভাঙা শিল্প

সৌমিত্র চক্রবর্তী, সীতাকুণ্ড

২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ১:৫৮ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত দেশের একমাত্র জাহাজভাঙা শিল্পের মালিকরা নানামুখী ট্যাক্স দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানিকালে কর্তৃপক্ষ একই জাহাজের পণ্যের উপর কখনো এডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) কখনো এডভান্স ট্যাক্স (এটি) আবার কখনো একই পণ্যের উপর দুই বা তিনবার বিভিন্ন ইস্যুতে ট্যাক্স আদায় করছেন। এভাবে প্রতিটি জাহাজে কোটি কোটি টাকা হারে অতিরিক্ত ট্যাক্স প্রদান করতে বাধ্য হচ্ছেন শিপইয়ার্ড মালিকরা। এর মধ্যে এ শিল্প থেকে প্রতিবছর আদায় করা এডভান্স ট্যাক্স পরবর্তীতে ফেরত প্রদানের কথা থাকলেও কাস্টমস কর্তৃক তাও ফেরত না দিয়ে গড়িমসি করছে। এতে ব্যবসার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন বেশিরভাগ মালিক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সাগর উপকূলীয় এলাকায় দেড় শতাধিক ইয়ার্ডের অনুমোদন আছে। কিন্তু নানান সমস্যার কারণে মালিকরা সব ইয়ার্ড চালু করেননি। তবে কয়েক বছর আগেও এখানে ৭০টির মতো ইয়ার্ড চালু ছিলো। বর্তমানে চালু আছে ৫২টি ইয়ার্ড। কখনো লাভ আবার কখনো ক্রমাগত লোকসান দিয়েই এ ইয়ার্ডগুলোকে চালু রেখেছেন মালিকরা। এর মধ্যে শিল্পে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় ছোবলটি আসে করোনা মহামারীতে। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার পূর্বে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম ছিলো প্রতি টন ৪০০ ডলার। এই মূল্যে লাখ লাখ টনের জাহাজ কিনে প্রতিটি ইয়ার্ডে আনার পরপরই করোনা মহামারীতে দাম পড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২৮০-৩০০ ডলার। এতে ক্রয়মূল্যের চেয়েও প্রতি টনে ১০০ ডলারেরও বেশি দাম পড়ে যাওয়ায় মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। ফলে আর কোন লোকসানের ঝুঁকি না নিয়ে গত জুন ও জুলাই মাসে অধিকাংশ মালিক স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি বন্ধ রাখেন। তবে জুলাই থেকে আবারো লোহার দাম বাড়তে থাকে। ফলে লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন শিল্পপতিরা। কিন্তু তাদের ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ নানারকমের ট্যাক্স তাদের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি করেছে। সীতাকুণ্ডের প্রবীণ শিল্পপতি ম্যাক কর্পোরেশন এর চেয়ারম্যান মাস্টার আবুল কাশেম বলেন, একটি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করার প্রক্রিয়া করতে গিয়ে আমাদেরকে বেশ কয়েকরকম ট্যাক্স, ভ্যাট দিতে হয়। এর মধ্যে এডভান্স ইনকাম ট্যাক্স এর নামে কাষ্টমস কর্তৃপক্ষ প্রতি টন লোহার উপর ৪ শতাংশ হারে বার্ষিক ২০-২৫ লাখ টন লোহার উপর কোটি কোটি টাকা আদায় করছে এ শিল্প থেকে। কিন্তু এই এডভান্স ট্যাক্স এর টাকা পরবর্তীতে ফেরত দেয়ার কথা থাকলেও কোন মালিক এই টাকা ফেরত পান না। এছাড়া প্রথমে পুরো স্ক্র্যাপ জাহাজের উপরে ভ্যাট দিয়ে জাহাজ আমদানির পর কর্তৃপক্ষ এখন আবার জাহাজের ভেতরে থাকা পণ্য জেনারেটর, ফার্নিচারসহ অন্যান্য পণ্যের জন্য আবারো আলাদা ভ্যাট দাবি করছে। কিন্তু মালিকরা একবার পুরো জাহাজের ভ্যাট দেয়ার পর আবার আলাদা আলাদাভাবে এসব ভ্যাট দিতে রাজি নন। মাস্টার কাশেম বলেন, এভাবে মালিকদের উপর নতুন নতুন ইচ্ছেমতো ভ্যাট, ট্যাক্স চাপিয়ে দিলে শিল্পটি আর বেশি দিন টিকবে না। প্রায় একই কথা বলেন শিল্পপতি আরেফিন এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান আলহাজ কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি আরো বলেন, এই শিল্প প্রতিবছর ২৫ লাখ টনেরও উপরে লোহার যোগান দিয়ে এ দেশের নির্মাণ শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমরা প্রতিবছর ১২শ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব দিচ্ছি। কিন্তু সামান্য ঘটনাকে পুঁজি করে আমরা জাহাজভাঙা শিল্প বিভিন্ন দপ্তর কর্তৃক যে হয়রানির শিকার হই তা আর কোন শিল্প হয় কিনা জানা নেই। তবে উল্টো চিত্রও আছে। অনেক সৎ কর্মকর্তাও আছেন। যারা আমাদেরকে সহযোগিতা করেন বলেই শিল্পটি এখনো আছে। আমরা তাদের নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। তবে জাহাজ ভাঙা শিল্প সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে এডভান্স ট্যাক্স এর টাকা ফেরত না দেওয়া এবং জাহাজের জন্য অগ্রিম ভ্যাট দেওয়ার পরও আবার বিভিন্ন পণ্যের জন্য আলাদা ভ্যাট দাবি করা। এ নিয়ে সম্প্রতি তারা ভ্যাট কমিশনারের সাথে বৈঠকও করেন। কিন্তু কোন সুরাহা হয়নি।

শিপব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকদের কাছ থেকে জাহাজ ও বিভিন্ন পণ্যের আলাদা আলাদ ভ্যাট আদায় বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার এনামুল হক বলেন, জাহাজগুলো যখন নির্মাণ হয় তখন তাতে কোন ফার্নিচার, জেনারেটর ইত্যাদি থাকে না। পরে সেগুলো সংযোজন করা হয়। এ কারণে স্ক্র্যাপ জাহাজ ও অন্যান্য সরঞ্জামের ভ্যাট নেওয়া হয়। এটি সরকারি নিয়ম অনুসারেই হয়ে থাকে। আর এটি বা এআইটি বিষয়ে কমিশনার এনামুল হক বলেন, এডভান্স যে ভ্যাট নেওয়া হয় তা নেওয়া হচ্ছে মালিকরা মালামালগুলো আবার বিক্রি করেন বলে। নিয়ম অনুযায়ী মালিকরা জাহাজের পণ্যগুলো যার কাছে বিক্রি করেন তার কাছ থেকে একটি ভ্যাটের চালান নিয়ে আমাদের কাছে জমা দেওয়ার কথা। তাহলে আমরা বুঝতাম যে তারা বিক্রিত পণ্যের ভ্যাটও দিয়েছেন। কিন্তু নির্দেশনা থাকার পরও মালিকরা জাহাজ আনার পর পণ্য বিক্রির আর কোন ভ্যাট চালান দেন না। কার কাছে বিক্রি করছেন সে সংক্রান্ত কাগজপত্র দিলেও আমরা ক্রেতার ভ্যাট যাচাই করে তাদের এডভান্স ট্যাক্স ফেরত দিতে পারতাম। তিনি বলেন, এগুলো সবই করা হয় আমাদের সরকারি নিয়ম অনুসারে। এ নিয়ে সম্প্রতি তাদের সাথে একটি বৈঠক হয়েছে। একটি রেজুলেশন হয়েছে। তা শীঘ্রই তাদের কাছে পৌঁছানো হবে। তাহলে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। তারা আইনটি যথাযথভাবে ফলো করছেন না বলেই হয়রানি মনে হচ্ছে। আর কিছু না।
বিএসবিআরএর সেক্রেটারি নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনার মধ্যে জাহাজের দাম পড়ে গেলেও শিল্পপতিরা তাদের কাজ চালিয়ে গেছেন। সীমিত আকারের মধ্যেও ১৫ হাজারের বেশি শ্রমিক এখানে নিয়মিত কাজ করে সংসার চালিয়েছে। সরকার যদি এডভান্স ট্যাক্স প্রত্যাহার করে এবং স্বল্প সুদে এ শিল্পকে ঋণ প্রদান করে তাহলে জাহাজভাঙা শিল্পটি রক্ষা পেয়ে একদিনে মালিক ও অসংখ্য শ্রমিকের পরিবার বাঁচবে আর অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে আরো বিশাল অবদান রাখবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট