চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ধুম্রজালে আটকা মিতু হত্যা

১৮ আগস্ট, ২০২০ | ৩:০০ অপরাহ্ণ

চাঞ্চল্যকর সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হয়নি চার বছরেও। এরমধ্যে আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। নিহত মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বরাবরাই দাবি করছেন, এই হত্যাকান্ডের জন্য তার মেয়ের স্বামী সাবেক এসপি বাবুল আক্তার দায়ী। তবে পিবিআই জানিয়েছে মামলার তদন্ত অনেকটা শেষ পর্যায়ে। তদন্তে এখনো বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তিনি মামলার বাদি হিসাবেই আছেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় খুন হন চট্টগ্রামে বিভিন্ন জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নেতৃত্ব দেয়া পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু।

পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদরদপ্তরে যোগ দিয়ে ওই সময় ঢাকায় ছিলেন বাবুল। তার আগে তিনি নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। হত্যাকান্ডের পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন বাবুল আক্তার নিজেই।

ওই বছরের (২০১৬ সালের ২৪ জুন) ঢাকার বনশ্রীর শ্বশুরের বাসা থেকে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর বাবুলকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শুরু থেকে গোয়েন্দা পুলিশ মামলাটির তদন্ত করছিল। তারা প্রায় তিন বছর তদন্ত করেও কোনো অভিযোগপত্র দিতে পারেনি। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে আদালত মামলাটি তদন্তের ভার পিবিআইকে দেয়।

মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই (মেট্রো) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মঈন উদ্দিন জানান, পূর্ববর্তী তদন্ত কর্মকর্তা মামলার তদন্ত অনেকটা শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এরমধ্যে আদালতের আদেশে মামলাটির তদন্ত করছে পিবিআই। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা আসামি ও মামলার সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে যত দ্রুত সম্ভব আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। করোনার কারণে এ কয়মাস কাজ করতে পারিনি।
বাবুল আক্তারকে আসামি করা হচ্ছে কি না প্রসঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা মঈন জানান, তিনি তো মামলার বাদি হিসাবেই আছেন। তদন্তে হত্যাকান্ডের সাথে এখনো তার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
খোঁজ মেলেনি মুছার: মিতু হত্যাকান্ডের কয়েক দিন পর ২০১৬ সালের ২৬ জুন এই মামলায় মো. আনোয়ার ও মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দুজনকে আটক করে পুলিশ। তারা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছা নামে একজনের ‘পরিকল্পনাতেই’ এ হত্যাকান্ড ঘটানোর কথা বলেন।
জবানবন্দিতে ওয়াসিম বলেন, নবী, কালু, মুছা ও তিনি ‘সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশ নেন’ এবং নবী ও কালু মিতুকে ‘ছুরিকাঘাত করে’।
জবানবন্দিতে আসা ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছা ও কালুর খোঁজ পুলিশ চার বছরেও ‘পায়নি’।
তবে মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার সেই সময় দাবি করেছিলেন, হত্যাকান্ডের ১৭ দিনের মাথায় মুছাকে বন্দর থানা এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। কিন্তু মুছাকে গ্রেপ্তারের বিষয় কখনো স্বীকার করেনি পুলিশ।
পুলিশ বাকলিয়া এলাকা থেকে ‘হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র সরবরাহকারী’ এহতেশামুল হক ভোলা ও তার সহযোগী মনিরকে পয়েন্ট ৩২ বোরের একটি পিস্তলসহ গ্রেপ্তার করে। উদ্ধার করা পিস্তলটি মিতু হত্যাকান্ডে ব্যবহার হয় বলে তখন পুলিশ দাবি করেছিল।
অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া ভোলাও গত বছরের ডিসেম্বরে জামিনে মুক্তি পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছেন। মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, “শুরু থেকে মামলার তদন্তে অনেকে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারা কাউকে গ্রেপ্তার করেছিল, কাউকে পায়নি আবার কেউ ক্রসফায়ারও হয়েছিল। জড়িত হিসেবে যাদের খোঁজা হচ্ছিল তাদের মধ্যে কার কী ভূমিকা ছিল, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।”
জানতে চাইলে মামলার আগের আইও নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) মো. কামরুজ্জামান বলেন, “আমরা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলাম। তদন্ত শেষ পর্যায়ে ছিল। আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলার তদন্তভার পিবিআইকে দিয়েছেন। আমরা তাদের ডকেট পাঠিয়েছি।”
এক নজরে মিতু হত্যা:
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে খুন হন মাহমুদা আক্তার মিতুg
৬ জুন: চকবাজার বড় গ্যারেজ এলাকা থেকে পুলিশ হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটি উদ্ধার করে। ওই দিন বাবুল আক্তার বাদি হয়ে পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন।
৮ জুন ও ১১ জুন : গোয়েন্দা পুলিশ হাটহাজারী উপজেলা থেকে আবু নসুর গুন্নু ও বায়েজিদ বোস্তামী থানার শীতল ঝর্ণা থেকে শাহ জামান ওরফে রবিন নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের খবর জানায়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিতু হত্যাকান্ডে এই দুজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
২৪ জুন : ঢাকার বনশ্রীর শ্বশুর বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
৬ জুন : মো. আনোয়ার ও মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দুজনের গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ করে পুলিশ। ওইদিন তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
২৮ জুন : বাবুল আক্তারের অন্যতম সোর্স এহেতাশামুল হক ভোলা ও তার সহযোগী মো. মনিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে পয়েন্ট ৩২ বোরের একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। যেটি মিতু হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত হয় বলে পুলিশের দাবি।
১ জুলাই : মোটরসাইকেল সরবরাহ করার অভিযোগে মুছার ভাই সাইদুল আলম শিকদার ওরফে সাক্কু ও শাহজাহান নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
৪ জুলাই : মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মুছাকে আদালতে হাজির করার দাবি করেন। ২২ জুন বন্দর থানা এলাকায় তাদের এক পরিচিত জনের বাসা থেকে মুছাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
৫ জুলাই : ভোরে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ঠান্ডাছড়িতে নুরুল ইসলাম রাশেদ ও নুরুন্নবী নামে দুইজন পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
১৩ আগস্ট স্ত্রীকে নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের নীরবতা ভাঙেন বাবুল আক্তার।
৬ সেপ্টেম্বর বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
১ নভেম্বর : ঢাকার বেসরকারি আল-দ্বীন হাসপাতালে সহযোগী পরিচালক হিসেবে বাবুল আক্তার যোগদান করেন।
২২ নভেম্বর : ভোলা ও মনিরকে অভিযুক্ত করে পুলিশের দেওয়া অস্ত্র মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে গ্রহণ।
১৫ ডিসেম্বর : তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রাম আসেন বাবুল আক্তার।
২০১৭ সালের জানুয়ারি : বাবুলের বাবা-মা ও শ্বশুর মোশারফ হোসেন ও শাশুড়ি সাহেদা মোশারফ নীলা চট্টগ্রাম এসে দেখা করেন তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে।
১৪ ফেব্রুয়ারি : ভোলার লালমোহন এলাকা থেকে মিতুর মোবাইল ফোনের সিম উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট