চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সোর্সদের চোর বলায় হেলালের লঙ্কাকাণ্ড !
সোর্সদের চোর বলায় হেলালের লঙ্কাকাণ্ড !

সোর্সদের চোর বলায় হেলালের লঙ্কাকাণ্ড !

‘এক লাখ টাকা থাকলে হয়ত আমার বুকের ধন বেঁচে থাকতো’- মারুফের মা

আল-আমিন সিকদার

১৮ জুলাই, ২০২০ | ২:১৪ অপরাহ্ণ

নগরীর আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ের লাকী প্লাজায় মদিনা ক্রোকারিজ নামের একটি দোকানে কাজ করতেন মৃত কিশোর সালমান ইসলাম মারুফ। আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ের মসজিদ গলির বাসিন্দা মারুফ। অভাবের সংসার হওয়ায় পরিবারে অর্থের যোগান দিতে এ কাজ করতেন মারুফ। কারণ, বাবা দিদার পেশায় একজন রিকশা চালক। তাইতো ১২ বছর বয়স থেকেই বাবার সাথে সংসারের হাল ধরে মারুফ। পাশাপাশি টিএন্ডটি উচ্চ বিদ্যালয়ে চালিয়ে গেছেন নিজের লেখাপড়া। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় বসার কথাও ছিল তার। ৩ বছর চাকরি করে জমানো টাকা দিয়ে বাবার সাথে ঠিক করেছে বসবাসের ভাঙা কুঁড়েঘরটি মেরামতের। মাথা গোঁজার জায়গা ঠিক করে ঘরে থাকা বিবাহ উপযুক্ত বোন নিহাকে বিয়ে দেয়ারও স্বপ্ন দেখেছিলো কিশোর মারুফ। কিন্তু সেই স্বপ্ন বুকে নিয়েই নিজের জীবন বলি দিল এই কিশোর।

কারণ, অপরিচিত দুই যুবককে চোর বলে সন্দেহ করায় তাকে তুলে নিয়ে যেতে চান নগরীর ডবলমুরিং থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হেলাল। কারণ, মারুফ যে দুই যুবককে চোর বলে জেরা করেছে তারা এসআই হেলালের সোর্স। সোর্সদের অপমান সইতে না পেরে মারুফকে ইয়াবা ব্যবসায়ী বলে তুলে নিয়ে যেতে চান এসআই মারুফ। হুমকি দেন একহাজার পিস ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার। মারধর করতে থাকেন মারুফকে। পরে মারুফকে বাঁচাতে তার মা রুবি আক্তার ও বোন নিহা এসআই হেলালের পা ধরে ক্ষমা চান। কিন্তু মন গলেনি এসআই হেলালের। উল্টো মারুফের মা রুবি আক্তার ও বোন নিহার ওপর নির্যাতন শুরু করে পুলিশ সদস্য হেলাল ও তার সাথে থাকা দুই সোর্স। আর এই ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে যায় মারুফ। এরপরপরই পুলিশের নির্যাতনে আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মারুফের বোন নিহা। পরে নিহা ও তার মা রুবি আক্তারকে এম্বুলেন্স যোগে হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। যা মারুফ জানতে পারে, ‘তার মা ও বোনকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ’। একপর্যায়ে অপমান সইতে না পেরে গলায় ফাঁস দিয়ে কিশোর মারুফ আত্মহত্যা করে বলে জানান স্থানীয়রা।

নিহত কিশোর মারুফের প্রতিবেশী ও প্রত্যক্ষদর্শী জাহিদ পূর্বকোণকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭ টায় দোকান বন্ধ করে বাসায় আসে মারুফ। ফ্রেশ হয়ে জানালার পাশে বসে সন্ধ্যার নাস্তা খাচ্ছিলো সে। একপর্যায়ে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে কয়েকজন যুবক তার জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। এর কিছুদিন আগে মারুফের সাইকেল ও টাকা চুরি হয়েছিল। মারুফ ভেবেছে কোন চোর হয়ত তার জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। তাই সে বের হয়ে উঁকি দেয়া দুই যুবককে ধরে ফেলে। এবং চোর বলে সবাইকে ডাকতে থাকে। পরে ওই দুই যুবক ডবলমুরিং থানার এসআই হেলালকে ডেকে আনেন এবং নিজেদের সোর্স বলে পরিচয় দেন। একপর্যায়ে সোর্স দুইজন মারুফকে ইয়াবা ব্যবসায়ী বলে এসআই হেলালকে ধরে নিয়ে যেতে বলেন। সোর্সদের চোর বলায় উত্তেজিত হয়ে পড়েন এসআই হেলাল। মারুফকে মারতে মারতে বের করার চেষ্টা করেন ঘর থেকে। তার সাথে থাকা ওই দুই সোর্সও এসময় মারুফকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চান। পরে মারুফকে বাঁচাতে তার মা রুবি আক্তার ও বোন নিহা এসআই হেলালের পা ধরে ক্ষমা চান। কিন্তু কোন কিছুতেই শান্ত হননি ওই পুলিশ। উল্টো তাদের (মা ও বোন) ওপরও নির্যাতন করতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের নির্যাতনে মারুফের বোনের হাত কেটে প্রচন্ড রক্ত বের হতে থাকে। সে ফাঁকে পালিয়ে যায় মারুফ। এসময় মারুফকে বাঁচাতে হলে একলাখ টাকা লাগবে বলে জানান এসআই হেলাল। অন্যথায় মারুফের বদলে থানায় যেতে হবে মারুফের মা ও বোনকে। টাকা দিতে না পারায় চারদিকে মারুফকে খুঁজতে থাকে হেলাল ও তার সোর্সরা। এরইমাঝে পুলিশের নির্যাতনে আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মারুফের বোন নিহা। পরে নিহা ও তার মা রুবি আক্তারকে এম্বুলেন্স যোগে হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। যা মারুফ জানতে পারে। আর সে অপমান সইতে না পেরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে মারুফ। আমাদের চোখের সামনে পুলিশ সদস্য হেলাল যে লঙ্কাকাণ্ড করলেন, তা কোন সাধারণ পুলিশ সদস্যের পক্ষে করা সম্ভব নয়।’

এদিকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মারুফের মা রুবি আক্তার বলেন, ‘আমার ঘরে এক লাখ টাকা থাকলে হয়ত আজ আমার বুকের ধন খালি হত না। আমার মেয়ে নির্যাতন হত না।’

এদিকে কোন ধরণের অভিযোগ কিংবা মামলা ছাড়া একটি সাধারণ পরিবারের সাথে পুলিশের এ কর্মকান্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ করেছে স্থানীয়রা। গত বুহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে অভিযুক্তদের শাস্তি দাবি করেন স্থানীয়রা। একপর্যায়ে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য এসআই হেলালকে তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) ফারুক-উল-হক। ঘটনা তদন্তে করেছেন তদন্ত কমিটি। যে কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা ছিল গতকাল শুক্রবার বিকেল ৫ টায়। তবে গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়নি তদন্ত কমিটি। এমনকি সংবাদকর্মীদের ফোনও রিসিভ করেননি সংশ্লিষ্টরা।

শুধু এই অভিযোগই নয়, লকডাউনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সন্ধ্যার পর দোকান খোলা রাখায় জাহিদুল নামে এক হোটেল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৬ হাজার টাকাসহ একাধিক ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখিয়ে লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগ রয়েছে, ডবলমুরিং থানার সিভিল টিমের দায়িত্বে ছিল এসআই হেলালের। যার প্রভাব খাটিয়ে সাদা পোশাকে মাইক্রোবাসে চেপে মানুষকে তুলে নিয়ে টাকা দাবি করতেন তিনি। টাকা দিতে না পারলে ইয়াবা দিয়ে মামলা ও অস্ত্র দিয়ে চালান দেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট