চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

ডিজিটাল হচ্ছে ওয়াসার বিল

নওশের আলী খান

১৭ জুলাই, ২০২০ | ১২:৪৭ অপরাহ্ণ

গ্রাহক হয়রানি ও অনিয়ম রোধে ডিজিটাল হচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির বিলিং পদ্ধতি। আগামী তিনমাসের মধ্যেই বসবে ডিজিটাল মিটার। বিলিং ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তি সংযোজিত হলে পানির ভুতুড়ে বিলের খড়গ থেকে মুক্ত হবে চট্টগ্রাম ওয়াসার গ্রাহকরা। পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাবে সিস্টেম লস তথা এআরডব্লিউ’র (নন রেভিনিউ ওয়াটার) আড়ালে বাইপাস লাইনের মাধ্যমে পানি চুরি। বিলিং ব্যবস্থার আধুনিকায়নে ইতোমধ্যে এএমআর (অটোমেটেড মিটার রিডিং) মিটার স্থাপনে অটোমেশন প্রকল্প হাতে নেয় ওয়াসা। পাইলট প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে বেছে নেয়া হয়েছে নগরীর ওআর নিজাম আবাসিক এলাকা, তৎসংলগ্ন হিলভিউ আবাসিক এলাকা, জামাল খান এবং চান্দগাঁও আবাসিক এলাকাকে। এ চার আবাসিক এলাকায় স্থাপন করা হবে তিন হাজার চারশ এএমআর মিটার। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন কোটি ২১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এএমআর মিটার সংযোজন হলে গ্রাহকের বাড়িতে গিয়ে আর মিটার চেক করে রিডিং নিতে হবে না। মিটারে থাকা ডিভাইস রিডারের হাতে থাকা লকারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিডিং পৌঁছে দেবে। অর্থাৎ রিডার এলাকা দিয়ে লকার নিয়ে ঘুরে আসলে ওই এলাকার সকল মিটারের রিডিং চলে আসবে। অফিসে গিয়ে কম্পিউটারে ইনপুট দিলে যাবতীয় ডাটা চলে আসবে। আবার মিটারের ডিভাইস নষ্ট হলে অটোমেটিক সংকেত দেবে। জানা গেছে, পরীক্ষামূলকভাবে এ ধরণের পাঁচটি মিটার ছয়মাস পূর্বে বসানো হয়েছে। ওয়াসার কারিগরি বিভাগ এগুলোর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ জানান, বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের আলোকে বিদ্যমান এনালগ পদ্ধতি বাদ দিয়ে পানির বিলিং ব্যবস্থা ডিজিটালে রূপান্তরের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। পাইলট প্রকল্পের যাবতীয় অর্থ ব্যয় হবে ওয়াসার নিজস্ব ফান্ড থেকে। গত মঙ্গলবার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন দেয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যেই প্রকল্পের দরপত্র আহবান করা হবে। ধারাবাহিকভাবে নগরীর প্রত্যেক পানির গ্রাহককে ডিজিটাল মিটারের আওতায় আনা হবে।

অন্যান্য সেবা খাতের মতো চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির বিল নিয়ে সারা বছরই গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ লেগে থাকে। সনাতন পদ্ধতিতে রিডিং দেখে বিল করার ক্ষেত্রে কাজে নিয়োজিত মিটার ইন্সপেক্টরদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নয়ছয়ের অভিযোগ। এমনও অভিযোগ রয়েছে, কতিপয় মিটার ইন্সপেক্টর কিংবা তাদের নিযুক্ত বদি আলমদের (মিটার ইন্সপেক্টর নিযুক্ত এলাকা ভিত্তিক বহিরাগত, তাদের সাংকেতিক নাম এটি ) সাথে মাসিক ভিত্তিতে লেনদেনের কন্ট্রাক্ট না করলে বিলে হেরফের করা হয়। বছরের অধিকাংশ সময় নষ্ট কিংবা ভাঙ্গা থাকে মিটার। তাদের সাথে সমঝোতা থাকলে বিল কম হয় এবং বাইপাস লাইন দিয়ে পানির চুরির সুযোগ দেয়া হয়। এছাড়া রিডিং না দেখে গড় বিলের কারণে সারাবছরই লেগে থাকে গ্রাহক হয়রানি।

জানা যায়, গত বছরের ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম ওয়াসার ৫৩ তম বোর্ড সভায় পানির বিল নিয়ে গ্রাহক হয়রানির বিষয় উত্থাপন করে বিলিং পদ্ধতি ডিজিটাল করার প্রস্তাব করেন বোর্ড সদস্য এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী। ওই বোর্ড সভায় তিনি বলেছিলেন, ওয়াসা সরবরাহ করা বিশুদ্ধ পানির উৎপাদন যদি ডিজটালে হয় বিলিং কেন এনালগে হবে। এনালগে সনাতন পদ্ধতিতে বিল করার কারণে বছর ধরে গ্রাহকদের বিশাল অংশ হয়রানিতে থাকেন। তাই উৎপাদন ব্যবস্থার মতো বিলিংয়েও ডিজিটাল প্রযুক্তির সংযোজন করা প্রয়োজন। বিলিং ব্যবস্থা অটোমেশন কিংবা প্রিপেইড হলে গ্রাহকদের কোন অভিযোগ থাকবে না। ওই বোর্ড সভায় প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে অনুমোদনের পর প্রকল্পটি হাতে নেয় কর্তৃপক্ষ।
প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম জানান, প্রকল্পটি যেহেতু ওয়াসার নিজস্ব অর্থায়নে হবে, তাই যেকোনো সময় দরপত্র আহবান করা যাবে। এসব প্রক্রিয়া শেষ করে আগামী অক্টোবর মাসে ডিজিটাল মিটার সংযোজন শুরু করা যাবে। তিনি বলেন, বিলিং ব্যবস্থার সংস্কার হলে ওয়াসা এবং গ্রাহক উভয়েই লাভবান হবে। সবচে’ বড় কথা ওয়াসার রাজস্ব আয় বেড়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিলিং পদ্ধতির আধুনিকায়ন হলে ওয়াসার এআরডব্লিউর (নন রেভিনিউ ওয়াটার) পরিমাণ অনেক কমে যাবে। বিদ্যমান সিস্টেম লসের বেশির ভাগ পানি বাইপাস লাইনের মাধ্যমে চুরি হয়। কিন্তু তাতে দেখানো হয় লিকেজের অজুহাত। বাস্তবে লিকেজের মাধ্যমে অপচয় হয় মাত্র ৫ শতাংশ। জানা গেছে, চট্টগ্রাম ওয়াসায় প্রতিমাসে মোট উৎপাদিত পানির ২৮ থেকে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত এনআরডব্লিউ থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অন্য উপায় ছাড়া এ পরিমাণ পানি পাইপ ফেটে লিকেজ হয়ে বেরিয়ে গেলে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বন্যা হওয়ার কথা। কিন্তু নগরীর কোথায় এ পরিমাণ পানির অপচয়ের রেকর্ড নেই। তাছাড়া নগরীর কোথাও ওয়াসার পাইপ লিক হলে সাথে সাথে মেরামত করা হয়। লিকেজ মেরামত কাজে ওয়াসার ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োজিত আছে আটটি মেনটেইন্যান্স টিম। তাছাড়া চারটি ডিভিশনে রয়েছে লিকেজ মেরামতের জন্য পৃথক জনবল। প্রসঙ্গত. চট্টগ্রাম ওয়াসার বর্তমানে গ্রাহক সংখ্যা ৭৩ হাজার। বিশাল সংখ্যক এ গ্রাহকের রিডিং দেখে বিল করেন মাত্র ৪৩ জন মিটার ইন্সপেক্টর।

অভিযোগ রয়েছে, মিটার ইন্সপেক্টরদের এ সংখ্যক গ্রাহকের বিল তৈরিতে হিমশিম খেতে হয়। তাই তারা এলাকা ভিত্তিক বদি আলমের মাধ্যমে রিডিং নিয়ে বিল করেন। এসব বদি আলমরা অসাধু গ্রাহকদের সাথে গোপন সমঝোতা করে বিল কমিয়ে নগদ ধান্ধায় ব্যস্ত থাকেন। তাদের মাধ্যমে চলে বাইপাস লাইনের কারসাজি। নয় তো অবৈধ ডিপটিউবওয়েল। মিটার ইন্সপেক্টররা থাকেন বদি আলমদের বসের ভূমিকায়।
এ প্রসঙ্গে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহ জানান, আমাদের কিছু দুর্নীতিবাজের সাথে কতিপয় অসাধু গ্রাহকের গোপন আঁতাতের বিষয়ে প্রায়ই অভিযোগ শুনি। উভয়ের সমঝোতায় নাকি পানি চুরি চলে। আমি বারবার বলে আসছি গ্রাহকরা যাতে কারও অবৈধ ফাঁদে পা না দেয়। বিল নিয়ে কেউ অনিয়ম করলে কিংবা কিছু চাইলে আমার কাছে অভিযোগ দিতে। কিন্তু কেউ অভিযোগ নিয়ে আসে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমি অবশ্যই ব্যবস্থা নিতাম। তিনি বলেন, বিলিং পদ্ধতি ডিজিটাল হলে এসব অবৈধ রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।

ওয়াসার বোর্ড সদস্য মহসীন কাজী বিলিং পদ্ধতির সংস্কার প্রসঙ্গে বলেন, বোর্ড সদস্য হওয়ার পর এমন কোন মাস নাই পানির বিল নিয়ে পরিচিত কারও না কারও অভিযোগ পাই না। কেউ না কেউ হয়রানির অভিযোগ করেই। খোঁজ নিয়ে জানলাম ডিজিটাল প্রযুক্তিতে উৎপাদিত পানির বিল হয় সনাতন পদ্ধতিতে। আধুনিক যুগে ওয়াসার মতো একটি বিশাল প্রতিষ্ঠানের জন্য এটা বেমামান। যেখানে এখন দোকানপাটের বিলও ডিজিটাল। তাই বিলিং পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে বোর্ড সভায় প্রস্তাব করি। বোর্ডের সকল সম্মানিত সদস্য অনুমোদন দেয়ায় প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখছে। এতে নিজের ভাল লাগার চেয়েও ভাল লাগছে গ্রাহকরা হয়রানিমুক্ত হবেন-এটা ভেবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট