চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভালবাসা সামাজিক জীবনের ফেভিকল

১৪ জুলাই, ২০২০ | ৯:৩০ অপরাহ্ণ

অনেক পুরানো একটা প্রবাদ মনে পড়ে গেল ! প্রবাদটা আমার দাদুর মুখে প্রায় শুনতাম, ‘‘ঘষে মেজে রূপ, আর ধরে বেঁধে পিরিত।’’

আমাদের বর্তমান সামাজিক অবস্থাটাও এখন ঠিক তাই। কোথাও যেন সত্যিকারের রূপ বা সেই ভালোবাসা নাই। সব কিছুতেই আছে শুধু কেমন যেন একটা লোক দেখানো ভাব বা ভণিতা।
ধরুন না, আমাদের পারিবারিক জীবনের কথাই বলি। আছে কি এখন আমাদের পরিবার নামক সেই পবিত্র পরিবেশে ভালোবাসার সেই বন্ধন? পরিবারের সেই সদস্যরা কি এখন আছি আগের মতন?
পরিবার ভেঙে এখন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে সব কাছের সম্পর্কগুলো স্বার্থের কাছে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে স্বামী-স্ত্রী থেকে, সন্তান মা-বাবা থেকে, ভাই বোনেরা একে অপর থেকে ছিটকে পড়েছি অনেক দূরে।

হয়তো বাস্তবতা এখন তাই। কেউ অর্থ উপাজনের জন্য, কেউ বিদ্যা অর্জনের জন্য আবার কেউ বা নিজ নিজ সামাজিক মর্যাদা টিকিয়ে রাখার জন্য বহুদূরে সরে গেছি। আমরা সবাই কেন যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছি। দাদুর সেই প্রবাদের মত।
আমি মনে করি সমাজে এখন যাই ঘটছে সব কিছু ঘটছে ভালোবাসা বা পারিবারিক বন্ধনের অভাবে। আধুনিকতার নামে আমরা নামতে নামতে এত নিচে নেমে গেছি যে, ভুলেই গেছি পরিবার নামে একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠান আছে আমাদের। যেখানে আছে বাবা, মা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী।

ব্যস্ততার সাগরে আমরা এতই তলিয়ে গেছি যে, পারিবারিক সম্পর্কগুলোর দিকে নজর দিতে ভুলেই গেছি। অর্থ উপার্জনের নেশায় বাবা-মায়েরা সন্তানদের জন্ম দেন ঠিকই, কিন্তু মানুষ করান আয়া দিয়ে। দিন দিন বাবা-মার ভালোবাসা বঞ্চিত ছেলে-মেয়েরা যারা আয়া দ্বারা বড় হয় তারা কি শিখছে? বড় হয়ে সেই সন্তান ও ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের মত তাদের জগত নিয়ে। ধীরে ধীরে জন্ম নেয় বাবা-মার প্রতি অশ্রদ্ধা। বিপরীতটা যে নেই তা নয়, তবে সেটা একেবারেই নগণ্য।

শিশু, কিশোর, আর ধর্ষনের মত অপরাধগুলোতে জড়িয়ে পড়ছে আজ আমাদের সন্তানেরা। জন্ম নিচ্ছে ঐশির মত মেয়েরা, যারা ছোট বেলায় অপরাধের শিক্ষা নেয় বাবা-মায়ের হাত ধরে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এক বিশাল ভূমিকা রাখছে এই ব্যস্ততা। দিন দিন অর্থ উপার্জনের নামে হারিয়ে যাচ্ছে একে অপরের জীবন থেকে, জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ঝামেলায়। এসব আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা। যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে মানুষ করেছে তাদের সন্তানদের। মানুষ হয়ে এই সন্তান মা-বাবার কতটুকুই খবর রাখছে? শেষ বেলায় এসে তাদের মনে প্রশ্নের উঁকি দেয় জীবন দিয়ে সন্তাদের কি ‘‘মানুষ না অমানুষ বানালাম’’।

নারী নির্যাতনের মত বড় অপরাধ যেমন অসভ্য যুগে ছিল তেমনি আছে আজকের এই ডিজিটাল যুগেও। ডিজিটাল যুগে চলছে ডিজিটাল নির্যাতন।
নারীদের একদিকে অর্থ উপার্জন, সংসার সামলানো থেকে শুরু করে সন্তানকে মানুষ করা, তাদের লেখাপড়া দেখা, তাদের যত্ন করে বড় করে তোলা সবই পড়ে তার ভাগে। নীরবে পালন করে যায় সেসব দায়িত্ব নিজের মনে করে। তবুও শান্তি নাই।
একজন পুরুষ মানুষ শুধু অর্থ উপার্জন করে ক্লান্ত। কিন্তু একজন নারী, অর্থ উপার্জন, সংসার দেখা, সন্তান মানুষ করা, শশুর বাড়ি সবার মন রক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেও শান্তি নাই। শুধু নারী বলে; এই নারী যখন থাকে বাপের মেয়ে, সাত খুন মাফ, যখন ঘরে বউ থাকে আসামির কাঠগড়ায় আর যখন মা তখন হয় অবহেলিত। আর পুরুষ এখানে রাজার হালে অর্থ উপার্জন করে ধন্য। বেচারি স্ত্রীরা, তাদের অবস্থা আমাদের সমাজে এমন- ‘‘কইলজা কাইট্টা রাইন্ধা দিলেও বলে লবণ কম হইছে।’’
আর এই সব কিছুর জন্য মনে হয় ভালোবাসাটাই দায়ী। একমাত্র ভালোবাসাই পারে সমাজ, সংসার তথা গোটা মানব জাতিকে বদলে দিতে। আমাদের সমাজে ভালবাসা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তার পবিত্রতা। তাই শুধু একমাত্র ভালবাসাই পারে আমাদের অস্থির সমাজটাকে স্থির করতে। কোন জিনিস ভেঙে গেলে যেমন আমরা ফেভিকল দিয়ে জোড়া লাগাই। তেমনি আমাদের এই ভেঙে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থাকেও সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ করে তুলতে পারে ভালোবাসার সেই ফেভিকল। একমাত্র ভালোবাসাই আমাদের দিতে পারে এই সুন্দর পৃথিবীর উপহার। যেখানে থাকবে শুধু আনন্দ, হাসি, আর সফলতা। তাই আমার মনে হয় আমাদের সমাজে ভালোবাসাটা এখন ফেভিকলের মত কাজ করবে। আর ভালোবাসাটাই হবে আমাদের জীবনের ফেভিকল।

– লেখক: সাবেক ব্যাংকার

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট