চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

পর্ব-২৬ঃ তাল আগ্নেয়গিরির দেশে

মো. ফারুক ইসলাম

৮ জুলাই, ২০২০ | ১২:১০ অপরাহ্ণ

১ জুলাই ২০১৯, সকালের সূর্যটা আজ মেঘের বুকে ঢাকা পড়ে গেছে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ফিলিপাইনে আজকে আমাদের বেড়ানোর শেষদিন। তাই সকাল থেকেই সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তাছাড়া আজকের বেড়ানোটা একটু ভিন্ন। এতোদিন বইপত্রে আগ্নেয়গিরির অনেক বর্ণনা পড়েছি। আজ স্বচক্ষে দেখবো, তা ভাবতেই এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছে মনে। সকালে মিস্টার জুন এবং তার টিমের সদস্যরা এসে উপস্থিত। টিমে আছেন, মিস্টার জুন, মারভিন পুলো, ক্যারোলিন পুলো, আরেকজনের নামটা জানা নেই। মোট চারজনের একটা টিম। ইউনিভার্সিটি হোটেলের ক্যাফেটেরিয়াতে সকালের নাস্তা সেরে সবাই গাড়িতে উঠলাম। বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি ছুটছে ফিলিপাইনের বাটাঙ্গাস প্রদেশের দিকে। বৃষ্টির মধ্যে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে আনন্দ করে সময় কাটানোটাকে উপযুক্ত মনে করলাম। সবাই গান, কবিতা আবৃত্তি, কৌতুক বলে পুরো গাড়ি সরব করে রাখলাম। ম্যানিলা শহর থেকে বাটাঙ্গাসের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। পুরোটাই পাহাড়ি এলাকা। গাড়ি ছুটছে বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে। কিন্তু রাস্তা এতই মসৃণ যে, কোথাও কোন গর্ত নেই, রাস্তার দু’পাশে সারি সারি সবুজ বৃক্ষ। সবুজ বৃক্ষের সারি পেছনে ফেলে গাড়ি সামনের দিকে ছুটছে। আমাদের সাথে আনন্দে অংশ নিচ্ছিল মারভিন পুলো এবং ক্যারোলিন পুলো। ফিলিপাইনের অনেক মজার মজার খেলা তারা আমাদের গাড়িতে শিখিয়ে দিচ্ছিল। পরবর্তীতে আমাদের টিম লিডার বাহারুল ইসলাম স্যার ক্যারোলিন পুলোর সাথে আমাকে আর মারভিন পুলোকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিক্ষিকা হালিমা আপার সাথে ফিলিপাইনের জনপ্রিয় খেলায় অংশ নিতে দিলেন।

মজার ব্যাপার হলো তাদের কাছ থেকে শেখা খেলায় তাদের সাথে সমান পাল্লা দিয়ে আমরা অংশ নিচ্ছিলাম। হালিমা আপা প্রায় হারিয়ে দিচ্ছিলেন মারভিন পুলোকে। আর আমি ক্যারোলিন পুলোকে শুরুতে হারিয়ে দিলাম। খেলাটার নিয়ম হলো স্টেপ ভুল করা যাবে না। স্টেপ ভুল করলেই শেষ। বাহারুল ইসলাম স্যার মারভিনকে ডাকতে লাগলেন পারভিন নামে। সবার হাসি দেখে কে! সবাই তাদের নিয়ে আনন্দে ডুবে গেছে। ফিলিপাইনে চাকরির খুব সংকট। সেটা মারভিন আমাকে বললো। তাই পড়ালেখা শেষ করে অনেককেই বেকার জীবন বেছে নিতে হয়। মারভিন পুলো আর ক্যারোলিন পুলো দুজনেই ভাইবোন হওয়ায় মারভিন তার ছোট বোনকেও এই কাজে সম্পৃক্ত করেছে। মারভিনের ভাষ্যমতে, তাদের মা অসুস্থ। মায়ের চিকিৎসা, সংসার খরচ সবকিছু যোগাড় করতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। বর্তমানে সে একটা চাকরি খুঁজছে। পথে যেতে যেতে গাড়ি কিছুক্ষণের জন্য একটু থামলো। রাস্তার পাশের দোকান থেকে কলা কিনে আমাদের পরিবেশন করা হলো। এরপর পুনরায় ছুটলাম তাল আগ্নেয়গিরির দেশে। পথ যেন শেষ হতে চায় না। আমরা অধীর আগ্রহে পথের শেষের অপেক্ষায় রইলাম। আবার দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল। কারণ এমন বৃষ্টির মধ্যে আগ্নেয়গিরির পাহাড়ে উঠতে পারবো কিনা। অবশেষে আমাদের যাত্রা শেষ হলো। আমরা পৌঁছে গেলাম বাটাঙ্গাসে। গাড়ি থেকে যখন নামছিলাম তখনও বৃষ্টির তাণ্ডব চলছিল। এতো বৃষ্টির মধ্যে তাল লেক পার হওয়াটা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সবাই তাল লেকের পাড়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগলাম। এদিকে, তাল লেকের সামনে এসে মিস্টার জুন বুদ্ধি খাটালেন যেন আমাদের তাল আগ্নেয়গিরি না দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আমাদের বাহারুল ইসলাম স্যার বললেন, আমরা তাল আগ্নেয়গিরি কাছ থেকেই দেখবো। এখান থেকে তো পাহাড় ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মিস্টার জুনের বুদ্ধি স্যার বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তার বুদ্ধিতে স্যারের মন গলেনি। ওইদিন বাহারুল ইসলাম স্যারের কারণেই আমরা তাল আগ্নেয়গিরি দেখতে পেরেছিলাম। বৃষ্টি কমে এলো। আমাদের জন্য স্পিড বোট ভাড়া করা হয়েছিল। সবাই বোটে উঠলাম তাল লেক পাড়ি দেয়ার জন্য। অসম্ভব সুন্দর একটা লেক।

পাহাড়ের বুক ছিড়ে এঁকে-বেঁকে চলে গেছে। লেকের মাঝামাঝি জায়গায় তাল আগ্নেয়গিরির অবস্থান। তাল আগ্নেয়গিরি সম্পর্কে জানা যায়, ফিলিপাইনের লুজন দ্বীপে তাল লেক দ্বারা ভরাট একটি বড় ক্যালডেরা এবং এটি বাটাঙ্গাস প্রদেশে। তাল আগ্নেয়গিরি ফিলিপিন্সের দ্বিতীয় সক্রিয়তম আগ্নেয়গিরি। তাল আগ্নেয়গিরি এবং লেক ফিলিপিন্সের সবচেয়ে মনোরম এবং আকর্ষণীয় দৃশ্য উপস্থাপন করে। এটি ম্যানিলা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত। তাল আগ্নেয়গিরির মূল গর্তে মূলত একটি লেক ছিল। এই আগ্নেয়গিরিতে অতীতে বেশ কয়েকটি মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটেছে, যার কারণে দ্বীপ এবং হ্রদের আশপাশের জনবহুল অঞ্চলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তাল আগ্নেয়গিরির দ্বীপের উত্তরের অর্ধেক অংশটি তালিসে হ্রদের তীরে শহর এবং দক্ষিণ অর্ধেক সান নিকোলাসের অন্তর্গত।
ফিলিপাইন ইনস্টিটিউট অব ভলকানোলজি এন্ড সিজমোলজি এই দ্বীপে স্থায়ী বসবাস নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পুরো দ্বীপটিকে একটি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল এবং স্থায়ী বিপদ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সতর্কতা সত্ত্বেও, কিছু পরিবার এই দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগ্নেয়গিরির পাশের হ্রদ থেকে মাছ ধরে এবং ফসলের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে সক্রিয় এই আগ্নেয়গিরিতে যখন বিস্ফোরণ ঘটে তখন এটি মারাত্মক রূপ ধারণ করে। সম্প্রতি এক বিস্ফোরণে আগ্নেয়গিরি এলাকায় বসবাসরত মানুষের মধ্যে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। পুরো ম্যানিলা শহরটি ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছিল। আকাশে বিমান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। সুপ্ত অবস্থায় এটিকে মনে হবে একটি সাধারণ লেক। কাছে গিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে লেকের অনেক অংশে আগুন বের হচ্ছে। আমাদের কাছে দেখার উপাদান হলেও ওই এলাকার মানুষের কাছে এটি ভয়ংকর মৃত্যু ফাঁদ। তবুও মানুষ এই পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে এখানে বসতি স্থাপন করেছে।-(চলবে)
পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট