চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

এবার স্বপ্নপূরণ হবে তো?
এবার স্বপ্নপূরণ হবে তো?

কালুরঘাট সেতু

এবার স্বপ্নপূরণ হবে তো?

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

৫ জুলাই, ২০২০ | ৪:২৪ অপরাহ্ণ

‘চমক’ আসছে কালুরঘাট সেতুর স্বপ্নপূরণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহে রেল কাম সড়ক-তিন লেনের সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে রেল বিভাগ। রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে। তিন লেনের সেতুটি দিয়ে এক লেনে রেল আর দু’লেনে গণপরিবহন চলাচল করবে। রেলওয়ের বিষয়টি অর্থ সহায়তাকারী দেশ কোরিয়ান সরকারকে আনুষ্ঠানিক জানানো হয়েছে। কোরিয়ান সরকার সম্মতি দিলে দ্রুত কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত মার্চ মাসে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে তিন লেনের যানবাহন চলাচল উপযোগী একটি সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সেতুর এক লেনে রেল ও দুই লেনে যানবাহন চলাচল করবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তটি দাতা সংস্থা কোরিয়ান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে এখন কাজ করছে কোরিয়ান সরকার। তাদের সিদ্ধান্ত পেলেই কাজ শুরু হবে কালুরঘাট সেতুর।
পূর্বের সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, রেল সেতু নির্মাণ করবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আর সড়ক সেতু করবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এখন রেলওয়ে রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তে দুই মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানি বা ঝক্কি-ঝামেলা আর রইল না।
ঢাকা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের পরিচালক (সংরক্ষণ) গোলাম মোস্তফা পূর্বকোণকে বলেন, ‘ইতোমধ্যেই রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সমীক্ষা করা হয়েছিল। সেভাবে প্রকল্প প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু গত বছর রেল ও সড়ক সেতু আলাদা করার মতামত দিয়ে একনেক সভা থেকে প্রকল্প ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এখন পূর্বের সমীক্ষা অনুযায়ী রেল কাম সড়ক-আলাদা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এখন আর তা হচ্ছে না। একটি সেতু হবে। রেল ও গণপরিবহন আলাদা লেনে চলাচল করবে। এক লেনে রেল ও যানবাহন চলাচল করলে, অন্য লেনে যেন সমস্যা সৃষ্টি না হয়, সেভাবেই সেতু নির্মাণ করা হবে। যাতে তিন লেনে স্বাভাবিকভাবে যানবাহন চলাচল করতে পারে।
তিনি বলেন, প্রকল্পটির বিষয়ে অধিকতর সমীক্ষা করা হচ্ছে। আশা করছি, শিগগিরই পুনঃসমীক্ষার কাজ শেষ হবে। একই সঙ্গে অর্থ সহায়তাকারী কোরিয়ান সরকারের সঙ্গেও নতুন করে সমঝোতা করতে হবে। দুটি কাজই দ্রুত করা হচ্ছে।
রেল সূত্র জানায়, বর্তমান সেতুর সংলগ্ন এলাকায় নতুন সেতু নির্মাণ করা হবে। উত্তরে রেল, দক্ষিণে সড়ক সেতু নির্মাণ করা হবে। তবে রেল সেতু হবে এক লেনের। আর সড়ক সেতু হবে দুই লেনের।
চট্টগ্রাম-৮ আসনের সাংসদ ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ পূর্বকোণকে বলেন, ‘কালুরঘাট সেতুর জন্য মানুষ আমাকে উজাড় করে ভোট দিয়েছেন। এক বছরের মধ্যে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। সেই লক্ষ্য নিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিবের সঙ্গে গত সপ্তাহে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ অনেক এগিয়ে নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।’
চট্টগ্রাম-দোহাজারী থেকে রেল যাবে টেকনাফের ঘুমধুম পর্যন্ত। ইতিমধ্যে ডাবল লেনের প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এই ডাবল লেনের রেল লাইনের সঙ্গে ‘সামাঞ্জস্য’ রেখেই কালুরঘাট সেতুর সমীক্ষা করা হচ্ছে। ঘুমধুম রেল লাইনের উপযোগী ডাবল লেনে রেল ও দুই লেনের সড়ক সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে প্রকল্পটি দ্রুত নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে কালুরঘাট সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। ২০১৮ সালে একনেক সভায় উঠেছিল কালুরঘাট সেতু প্রকল্পটি। কিন্তু অধিকতর সমীক্ষার জন্য ফাইলটি একনেক সভা থেকে ফেরত পাঠানো হয়। এরপর রেল ও সড়ক সেতু আলাদা করার কথা ওঠে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘রেল সেতুর পাশে আরেকটি সড়ক সেতু নির্মাণ করা হবে। রেল সেতু নির্মাণ করবে রেল মন্ত্রণালয়। আর সড়ক সেতু নির্মাণ করবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ।’ এখন প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ করবে রেলপথ মন্ত্রণালয়। দুই মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানি আর হচ্ছে না।
সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহমদ পূর্বকোণকে বলেন, ‘সড়ক বিভাগ আলাদা সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞও নিয়োগ করেছিল সওজ। পরবর্তীতে রেল কর্তৃপক্ষ সড়ক কাম রেল সেতু নির্মাণের পরিকল্পনার বিষয়টি মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের জানানো হয়। এই ধরনের চিঠি পাওয়ার পর আলাদা সড়ক সেতু নির্মাণ থেকে সরে আসে সওজ। বিষয়টি চিঠি দিয়ে রেল মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়। এখন রেল কর্তৃপক্ষই রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ করবে।’
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. নাছির উদ্দিন গতকাল শনিবার পূর্বকোণকে বলেন, ‘কালুরঘাটে ডাবল লেনের উপযোগী নতুন রেল সেতু নির্মাণের ফিজিভিলিটি স্টাডি করা হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে সমীক্ষার কাজ শেষ হবে।’
আওয়ামী লীগ সরকারের (২০০৮-২০১৩) প্রথম বর্ষপূতি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে কর্ণফুলী নদীর ওপর আরেকটি কংক্রিট সেতু নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছিলেন। ২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর হযরত শাহ আমানত সেতুর (তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শিকলবাহায় অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় এই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৯০ বছরের পুরোনো কালুরঘাট সেতুর অবকাঠামো এখন নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। জীর্ণশীর্ণ সেতু দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক মৃত্যু সওয়ারি হচ্ছেন। তালি জোড়া দিয়ে কোনো রকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ‘৮০’র দশকে সেতুর মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। এরপর থেকে জোড়াতালি দিয়ে সেতুটি টিকিয়ে রাখা হয়েছে। ২০০১ সালে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল রেল কর্তৃপক্ষ। ১০ টনের অধিক ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তারপরও জরাজীর্ণ সেতুর উপর প্রতিদিন চলাচল করছে ২০-৩০ টন ওজনের ভারী যানবাহন। এ বিষয়ে কোন নজরদারি নেই রেল কর্তৃপক্ষের।
কালুরঘাট সেতুর টোল ও রেলওয়ে সূত্র জানায়, কালুরঘাট সেতু দিয়ে দৈনিক চারটি যাত্রীবাহী ট্রেন ও তেলবাহী একটি ওয়াগন চলাচল করে। ছোট-বড় মিলে কমপক্ষে ৩০-৪০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। ট্রেন ও বিভিন্ন যানবাহনে প্রতিদিন দেড় লক্ষাধিক মানুষ সেতু পারাপার হয়। একমুখী সেতুর জন্য বহুমুখী দুর্ভোগ-যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে সেতু পারাপারকারীদের। এতে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৩০ সালে নির্মিত কালুরঘাট রেল সেতুটির মেয়াদ ৮০’র দশকের দিকে ফুরিয়ে যায়। ৮৮ বছরের পুরোনো এ সেতুটির অবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ সেতুটি। যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট