চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

‘উপসর্গে’ করোনার চেয়েও মৃত্যু বেশি

ইমাম হোসাইন রাজু

৫ জুলাই, ২০২০ | ৪:১৩ অপরাহ্ণ

মো. তানভীরুল হক (ছদ্মনাম)। মধ্যবয়সী এ যুবক গত ২৮ জুন তীব্র জ্বর নিয়ে ছুটে আসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। করোনা ইউনিটের ইয়োলে জোনে ভর্তির কয়েক ঘণ্টা পর মৃত্যু হয় তার। কিন্তু আজও তার পরিবার জানতে পারেনি, কী কারণে মারা গেল মধ্যবয়সী এ যুবক। তবে তানভীরের ‘করোনা উপসর্গে’ মৃত্যু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক-নার্সরা জানিয়েছেন বলে দাবি পরিবারের। সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও মৃত্যুর সঠিক তথ্য অজানাতেই রয়ে গেল তার।

শুধু তানভীরই নয়, চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের পর থেকে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া এমন অসংখ্য জনের কারণ আজও জানা যায়নি। তার সঠিক তথ্যও নেই স্বয়ং দায়িত্বশীল স্বাস্থ্য বিভাগের কাছেও। যদিও পৃথক পৃথক ভাবে সংগ্রহ করা প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, চট্টগ্রামে গত তিন মাসে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে প্রায় সাড়ে সাতশ’র অধিক ব্যক্তির। তবে বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে এ মৃত্যুর সংখ্যা হাজারের অধিক। যদিও এ বিষয়ে স্বয়ং দায়িত্বশীল সংস্থা জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়েও সঠিক তথ্য নেই। নেই স্বাস্থ্য দপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়েও।

তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, হাসপাতালের কোভিড ইউনিটের ইয়োলে জোনে ৫ এপ্রিল থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে সাড়ে চারশ’ এর অধিক। এছাড়া রেড জোনে ২১ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত তথ্যে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয় প্রায় ৪০ জনের। সর্বমোট এ হাসপাতালের করোনা ইউনিটেই গত তিনমাসে মৃত্যু হয়েছে পাঁচশ’র অধিক। তবে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট তথ্যে এ সংখ্যা সাত শতাধিক বলে জানা যায়। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, শুধুমাত্র ভর্তিরত রোগীদের তথ্য তাদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে পথে কিংবা জরুরি বিভাগে এসে মৃত্যু হওয়া ব্যক্তিদের তথ্য সংযুক্ত নেই সেই তালিকায়।
এছাড়া চট্টগ্রামের কোভিড ডেডিকিটেড হাসপাতাল চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে গত ৩ এপ্রিল থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে সর্বমোট ১০২ জনের। যাদের মধ্যে আক্রান্ত রোগী ছিল প্রায় ৫০ জন। বাকি ৬২ জন উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ১৪ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপসর্গ নিয়ে ১৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়। এর বাইরে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালেও মৃত্যুর সংখ্যা কম নয়। কিন্তু সে সঠিক তথ্য নেই সিভিল সার্জন কার্যালয় কিংবা স্বাস্থ্য দপ্তরেও।

এদিকে, গতকাল শনিবার সকালে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রকাশিত করোনার সর্বশেষ তথ্যে জানানো হয় চট্টগ্রাকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সর্বমোট ৯ হাজার ৬৬৮ জন। যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৮৭ জনের। সে হিসেবে আক্রান্তের চেয়ে উপসর্গে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় পাঁচগুণের বেশি।

আক্রান্তের চেয়ে উপসর্গে চট্টগ্রামে মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি হলেও এ বিষয়ে সঠিক কোন ধারণাই নেই স্বাস্থ্য বিভাগের। জানা নেই মৃত্যুর সঠিক কারণও। এছাড়া মৃত্যু হওয়া অনেককেই কোভিড পরীক্ষার আওতায়ও আনা হচ্ছে না। যদিও চিকিৎসকদের ধারণা উপসর্গে মৃত্যুর অধিকাংশই পজেটিভ। তবে এ বিষয়ে গবেষণা বা কারণ জানার মতোও নেই চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগের কোন পৃথক বিভাগও কিংবা উদ্বেগও। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের প্রতিটি মৃত্যুর কারণ জাননতে পরীক্ষা করার দরকার ছিল। নমুনা সংগ্রহ করলে বোঝা যেতো কী কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বক্তব্য ও পরামর্শ:

আক্রান্তের চেয়ে কি উপসর্গ ভয়ংকর? জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আব্দুর রব মাসুম পূর্বকোণকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্তের চেয়ে যে হারে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হচ্ছে, তাদের অনেকের পরীক্ষা হয়নি। আবার অনেকেই মৃত্যু হওয়ার পর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সে হিসেবে মৃত্যুর অধিকাংশই পজেটিভ। আবার যাদের মৃত্যু হচ্ছে তাদের বেশিভাগই জ্বর সর্দি ছাড়াও অন্যান্য রোগে ভুগছেন। বিশেষ করে হার্ট, কিডনি, শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। যার কারণে তাদের মৃত্যু দ্রুত হচ্ছে। তবে উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ এ চিকিৎসকের।’
চমেক হাসপাতালের ভয়ংকর মৃত্যুর চিত্র নিয়ে কথা হলে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, ‘কোভিড ইউনিটের ইয়োলো জোনে সাসপেক্টেট আর রেড জোনে পজেটিভ রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। এরমধ্যে যারাই হাসপাতালে উপসর্গ  নিয়ে ভর্তি হয়, তাদের প্রথম পর্যায়ে ইয়োলে জোনে থাকতে হয়। এরমধ্যে অনেকের হার্ট, কিডনিসহ অন্যান্য সমস্যা থাকে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তাদের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে রেফার করা যায়না। এছাড়া রেড জোনের আইসিইউ, এইচডিউসহ অক্সিজেন সুবিধা ইয়োলো জোনের চেয়ে বেশি। যার কারণেই উপর্সগ নিয়ে মৃত্যুর হারও বেশি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাভাইরাস কন্ট্রোল রুমের কোয়ারেন্টাইন ম্যানেজমেন্টের জয়েন্ট ফোকাল পার্সন ও চট্টগ্রাম জেলার সাবেক সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী পূর্বকোণকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের চেয়ে বড় ‘ভাইরাস’ হলো মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে আতঙ্ক। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি চিকিৎসকরা সচেতনতার ওপর জোর দিয়ে আসছেন। যদিও পূর্বের তুলনায় মৃত্যুর হার অনেক কমেছে। সচেতনা বাড়াতে পারলে সামনে এ সংখ্যা আরও কমে আসবে। বিশ্বে করোনাভাইরাসে যে সংখ্যক মৃত্যু হচ্ছে এর চেয়েও অনেক বেশি মৃত্যু হচ্ছে অন্যান্য রোগে বা উপসর্গে। তাই এ নিয়ে আতংঙ্ক হওয়ার কিছুই নেই। কিন্তু উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করার তাগিদ এ বিশেষজ্ঞের।’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট