চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শ্বাসের আশ্বাসে হাত বাড়াল চমেকের প্রাক্তনেরা

আহমেদ শরীফ শুভ

২৭ জুন, ২০২০ | ২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

দেশের অন্যান্য হটস্পটের মতো চট্টগ্রামেও কোভিড পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে মে মাসের শেষ দিকে। শ্বাসকষ্ট নিয়ে কোভিড আক্রান্ত রোগী হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে থাকে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের যথেষ্ট প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা সুবিধার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

শুধু তাই নয় এই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে সেবাদানকারী চিকিৎসকরাও। যেহেতু কোভিডের কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই তাই হাসপাতালে ভর্তি শ্বাসকষ্টে থাকা রোগীদের প্রধান চিকিৎসাই হচ্ছে পর্যাপ্ত অক্সিজেন দেয়া। যাদের অবস্থা গুরুতর তাদের আবার দিতে হয় উচ্চ প্রবাহমান (হাই-ফ্লো) কিংবা শ্বাসযন্ত্রে অবিরাম চাপে প্রবাহমান (কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার) অক্সিজেন। শুধু সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনই সেজন্য যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন হয় হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা এবং সি-প্যাপ মেশিনসহ বেশ কিছু উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি। কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে সেসবের কিছু ছিল না বললেই চলে। সে কারণে রোগীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছতে থাকে এবং অনেকের মৃত্যু প্রতিরোধ করা দুরূহ হয়ে পড়ে।
চট্টগ্রামের এই সংকটে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সামর্থ্যবানগোষ্ঠির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ৩ জুন থেকে দৈনিক পূর্বকোণ শুরু করে ‘শ্বাস নিতে চায় চট্টগ্রাম’ ক্যাম্পেইন। এই ক্যাম্পেইন ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। প্রথমদিকে একটু ধীর গতিতে হলেও পরে এই ক্যাম্পেইনে গতির সঞ্চার হয় এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপতিরা এই পরিস্থিতি উত্তরণে সহায়তার হাত বাড়াতে শুরু করেন। তবে সংগঠিতভাবে এগিয়ে আসতে শুরু করেন প্রবাসে থাকা চমেকের (চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের) প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অষ্ট্রেলিয়ায় কর্মরত চমেকের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা এ ব্যাপারে পথিকৃৎ হয়ে এগিয়ে এসেছেন। তাদের বদান্যতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটরসহ বেশ কিছু যন্ত্রপাতি। আরো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি চট্টগ্রামে পৌঁছানোর অপেক্ষায় আছে, ক্রয়ের প্রক্রিয়ায় আছে আরো কিছু।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রবাসী প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সবচেয়ে বড় অংশ কর্মরত আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এই উদ্যোগে তাদের সাথে কানাডা প্রবাসী অনেকেই যোগ দিয়েছেন। স্বভাবতঃই সামগ্রিক উদ্যোগের সবচেয়ে বড় অবদানটি আসছে তাদের দিক থেকে। তাদের পাঠানো এবং প্রেরণের প্রক্রিয়ায় থাকা সরঞ্জামের মধ্যে আছে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর, পালস-অক্সিমিটার, সাধারণ ন্যাজাল ক্যানুলা, এন-৯৫ মাস্ক ইত্যাদি। তারা সহসাই বিপুল সংখ্যক যন্ত্রপাতি পাঠাতে পারবেন বলে উদ্যোক্তারা মনে করছেন।
অষ্ট্রেলিয়ায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রাক্তনদের সংখ্যা সে তুলনায় অনেক কম হলেও সেখান থেকে ইতিমধ্যেই ৪টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা চট্টগ্রামে পৌঁছে গেছে। আরো ১০টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা এবং ৬টি সি-প্যাপ মেশিন পাঠানো প্রক্রিয়াধীন আছে। সেখান থেকেও আরো বেশকিছু যন্ত্রপাতি পাঠানো হবে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যে চমেকের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা এখনো কোন স্বতন্ত্র উদ্যোগ না নিলেও তারা ইংল্যান্ড প্রবাসীদের ‘চট্টগ্রামের শ্বাসের জন্য আশ্বাস’ প্রকল্পের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। সেখান থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যন্ত্রপাতি পাঠানো সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
তিন মহাদেশে ছড়িয়ে থাকা চমেকের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের এই উদ্যোগগুলো স্বতন্ত্রভাবে নেয়া হলেও তাদের মধ্যে পরিকল্পনা ও অগ্রাধিকার নির্ধারণে সমন্বয় রয়েছে। সংগঠকদের বিশ্বাস, তাদের পাঠানো যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পর সেখানকার কোভিড রোগীদের শ্বাসকষ্ট নিরসনে তা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে উদ্যোক্তারা প্রেরিত যন্ত্রপাতির সুুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের উপর জোর দিয়েছেন। রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থাকলে তাদের সে উদ্যোগ অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে। তারা মনে করেন প্রবাসে কর্মরত চমেকের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠানো সরঞ্জামাদি সরকারি অর্থায়ন ও সরবরাহের বিকল্প নয়, পরিপূরকমাত্র। তারা আশা করেন সরকারি অর্থায়ন ও সরবরাহ তার নিজস্ব গতিতে চললে সব উদ্যোগের সমন্বয়ে কোভিড আরোপিত শ্বাসকষ্ট থেকে চট্টগ্রামবাসী মুক্তি পাবেন।
উত্তর আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও অষ্ট্রেলিয়ায় কর্মরত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের মত দেশে অবস্থানরতদেরও কেউ কেউ এগিয়ে আসছেন। তারা আরো অধিকসংখ্যক এবং সংগঠিতভাবে এগিয়ে আসবেন এটা সবাই প্রত্যাশা করছেন। সেই সাথে অন্যান্য দেশে অবস্থানরতও এগিয়ে আসতে পারেন। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকায় চমেকের অনেক প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী কর্মরত আছেন। সবাই এগিয়ে এলে চট্টগ্রামবাসীর শ্বাসের আশ্বাস আরো বেগবান হবে। আরেকটি বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য, কোভিডআরোপিত এই শ্বাসকষ্ট শুধু চট্টগ্রামেই সীমাবদ্ধ নয়। অন্যান্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও রোগীদের আহাজারি দৃশ্যমান কিংবা সহসাই দৃশ্যমান হবে। দেশে ও প্রবাসে অবস্থানরত সেসব মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা চমেক প্রাক্তন ছাত্র- ছাত্রীদের অনুরূপ উদ্যোগ নিলে ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর ও বরিশালসহ অন্যান্য শহরের কোভিড রোগীরাও উপকৃত হবেন, অনেক মৃত্যু প্রতিরোধ করা যাবে।
দেশের ক্রান্তিলগ্নে চট্টগ্রাম বহুবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। চমেকের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে কোভিডআরোপিত শ্বাসকষ্ট নিরসনে চট্টগ্রাম আবারো দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পেয়েছে।
লেখক : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও অষ্ট্রেলিয়ায় কর্মরত ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট